বিশেষ প্রতিবেদন

চামড়াশিল্পের ভবিষ্যৎ কোন পথে?

রাজধানীর হাজারীবাগে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় সেখানকার ট্যানারিগুলোর উৎপাদন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস সংযোগ না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতেও। ফলে দেশের চামড়াশিল্পে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ট্যানারি দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ খাত। শীর্ষে থাকা তৈরি পোশাক খাতের কাছাকাছি একমাত্র চামড়াশিল্প যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে দেশের এ খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে ট্যানারির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। থেমে গেছে রফতানিও। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই ২০১৬ থেকে এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ১০১ কোটি ৮৯ লাখ মার্কিন ডলার।

আগের অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি ছিল ৯২ কোটি তিন লাখ ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে চামড়া খাত থেকে রফতানি আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ।

Advertisement

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয় ৯২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ রফতানি আয় বাড়ে ছয় কোটি ৯০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে এ খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে নয় কোটি ৫৯ লাখ ডলার। যা আগের বছর থেকে দুই কোটি ৬৯ লাখ ডলার বা ৩৯ শতাংশ বেশি।

ট্যানারি-মালিকদের অভিযোগ, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না করেই হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) পক্ষ থেকে আদালতে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে।

চামড়া শিল্পনগরীতে গ্যাস সংযোগ না দিয়েই বিসিক আদালতে জানায় যে, হেমায়েতপুরে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দেয়ার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও অভিযোগ মালিকদের।

Advertisement

তারা বলছেন, বিসিক আদালতে আরও জানায় যে, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইসিপি) দু’টি মডিউল প্রস্তুত রয়েছে। ট্যানারি-মালিকরা সাভারে না যাওয়ায় মেশিনগুলো নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেয়া হয়েছে।

‘কিন্তু বাস্তবে সাভারে ৫০টি কারখানার শোধনও সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্যগুলো ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি দূষিত এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে’ যোগ করেন ট্যানারি-মালিকরা।

তাদের দাবি, সম্ভাবনাময় ট্যানারি খাত রক্ষা করতে দ্রুত হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হবে। চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি-মালিকদের জমি রেজিস্ট্রেশন করে দিতে হবে। একই সঙ্গে ট্যানারি-মালিকরা যাতে সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারেন সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

একাধিক ট্যানারি-মালিক জাগো নিউজকে বলেন, শিগগিরই ট্যানারির উৎপাদন স্বাভাবিক করা না গেলে বিদেশি ক্রেতা হারাবে বাংলাদেশ। এতে শুধু ট্যানারি-ব্যবসায়ীরাই নয়, দেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রফতানি আয়েও।

গত ৮ এপ্রিল হাজারীবাগে থাকা কারখানার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ সব ধরনের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর থেকে হাজারীবাগের কারখানাগুলোর উৎপাদান বন্ধ রয়েছে। হাজারীবাগের সংযোগ বিচ্ছিন্নের আগে ও পরে ট্যানারি-মালিকদের পক্ষ থেকে সাভারে গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য একাধিকবার দাবি জানানো হয়। মালিক-শ্রমিকদের সমন্বয়ে হয় মহাসমাবেশ। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে দেশের ট্যানারি খাত কঠিন সময় পার করছে। এ পরিস্থিতি থেকে চামড়াশিল্প রক্ষা করতে হলে নগদ প্রণোদনা দিতে হবে। চামড়া শিল্পনগরীতে জমি রেজিস্ট্রির পাশাপাশি দ্রুত গ্যাস সংযোগও দিতে হবে।

‘ব্যাংক ঋণের জন্য জনতা ব্যাংকে গিয়েছিলাম। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রেশনের কাগজ জমা না দিলে কোনো ঋণ দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ব্যাংকটি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ট্যানারি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে’- বলেন তিনি।

সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, গার্মেন্টসের কাছাকাছি যদি কোনো খাত রফতানি আয় করতে পারে, সেটি চামড়াশিল্প। সাভারে পুরোপুরিভাবে ট্যানারি কার্যক্রম চালানো গেলে এ খাত থেকে রফতানি আয় অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু শিগগিরই ব্যবস্থা না নিলে রফতানি-ই বন্ধ হয়ে হবে।

‘এরই মধ্যে অনেক ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একবার বায়ার (ক্রেতা) হারালে তা আর ফিরে পাওয়া সহজ হবে না।’

হাজারীবাগের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্নের সময় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেছিলেন, ‘দেশের চামড়াশিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেননা গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকলে এ শিল্প ধ্বংস হতে বাধ্য।’

‘চামড়া শিল্পনগরীতে অবিলম্বে কার্যক্রম চালানো না গেলে উৎপাদন কমে যাবে। আর তখনই বায়াররা অন্য দেশে চলে যাবে। আমাদের চামড়া বাইরে পাচার হয়ে যাবে।’

এদিকে, পাটশিল্পের মতো দেশের চামড়াশিল্পও ধ্বংসের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চামড়াশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে ভারত। দেশটির স্বার্থে দেশের কতিপয় লোক আমাদের চামড়াশিল্প ধ্বংসের পায়তারা করছে। এ বিষয়ে সরকারের আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

এমএএস/এমএআর/পিআর