দেশজুড়ে

কুমিল্লায় নজরুলের স্মৃতি বিলুপ্তির পথে

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে) প্রেম, দ্রোহ, মানবতা ও সাম্যের প্রতীক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৮ তম জন্মজয়ন্তী। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও স্থানীয় প্রশাসন ও নজরুল প্রেমীদের উদ্যোগে কুমিল্লা মহানগরী ও মুরাদনগরের কবি তীর্থ দৌলপুরে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়েই দিবসটি পালিত হচ্ছে।

Advertisement

কিন্তু যাকে ঘীরে প্রতি বছর জন্মজয়ন্তীতে এত আয়োজন, কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই কবির স্মৃতি রক্ষায় উদাসীন সবাই। প্রতি বছর কবির জন্ম ও মৃত্যু-বার্ষিকীতে কবির স্মৃতি রক্ষায় নজরুল প্রেমীদের অনেক প্রতিশ্রুতি ও তৎপরতা দেখা দিলেও পরে কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা কিংবা সংরক্ষণে নেয়া হয় না কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।

সংরক্ষণ আর বেদখলের কারণে কুমিল্লা ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবির অনেক স্মৃতিচিহ্নও এখন বিলুপ্তির পথে। কবি তীর্থ মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবি নজরুল-নার্গিসের নামে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার সরকারি প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়াও ওই গ্রামে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল-নার্গিস বিদ্যা নিকেতন সরকারি এমপিওভুক্তি না হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

কুমিল্লায় নজরুল-নজরুলের কুমিল্লা

Advertisement

কুমিল্লা গোমতীর এপারে প্রমীলা ওপারে নার্গিস। কবি নজরুল ইসলামের হৃদয়ের দুই সারথী। এ দু’জনকে ঘিরেই কবি নজরুলের প্রেম আর বিরহের অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত কেটেছে কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লা শহর ও দৌলতপুর থেকে কবির অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখন বিলুপ্তির পথে।

জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা আসেন ৫ বার। কবির বিয়ে থেকে শুরু করে দু’দফায় গ্রেফতার হন এ জেলায়। প্রমীলা দেবীর বাড়ি, ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে কবিতা গানের আসর, ঝাউতলায় গ্রেফতার হওয়া, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, নানুয়া দীঘির পাড়, দারোগা বাড়ি, ইউছুফ স্কুল রোড, মহেশাঙ্গন, কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও মাঠ, দক্ষিণ চর্থায় শচীন দেব বর্মনের বাড়ি, নবাব বাড়ি, ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়ি, নজরুল এভিনিউ, কান্দিরপাড়, ঝাউতলা, রানীর দীঘির পাড়, রেল স্টেশন, কোতোয়ালি থানা, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং মুরাদনগরের দৌলতপুরসহ কুমিল্লা শহরের অসংখ্য স্থানে কবির স্মৃতি চিহৃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে নেই কোনো স্মৃতিফলক।

১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে কবির প্রথম আগমন ঘটে জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে। এ গ্রামেরই কবির পূর্ব পরিচিত বন্ধু আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে। এ সময় আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা নার্গিস আরা খানমের মাঝে তার মানসীর ছবি খুঁজে পান। দু’জন দু’জনার কাছাকাছি আসেন। এ প্রেম পল্লবিত হয়ে প্রণয়ে পরিণত হয়। কবি নার্গিসকে একই বছরের ১৭ জুন বিয়ে করেন। যা ছিল তার জীবনের প্রথম বিয়ে।

কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কবি বাসর রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লা শহরে চলে আসেন। শহরে কবি ইন্দকুমার সেনের বাসায় অবস্থান করেন। দৌলতপুরে মামার বাড়িতে কবির সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে স্থায়ী না হলেও শহরে কবি ইন্দকুমার সেনের বাসায় অবস্থানকালে তার ভ্রাতৃজয়া গিরিলা দেবীর একমাত্র কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলার (কবির দেয়া নাম) সঙ্গে পরিচয় প্রেম এবং তারপর ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল শুক্রবার কলকাতার ৬নং হাজী লেনে তাদের বিয়ে হয়।

Advertisement

কবি দ্বিতীয়বার কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে। এসময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী গান গাওয়ার কারণে গ্রেফতার হন। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর শহরের ঝাউতলা থেকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার হন কবি। সর্বশেষ কবি পঞ্চমবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই। এ ছিল তার কুমিল্লায় শেষ আসা। কবি নজরুল আর নার্গিসের বিচ্ছেদ হলেও ১৫ বছর অপেক্ষার পর কলকাতা থেকে তার তালাকনামা এনে নার্গিস পরে কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।

কবির অনেক স্মৃতিচিহ্ন বেদখল ও বিলুপ্তির পথে

১৯৮৩ সালে কবির স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহে তৎকালীন জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী জেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো হয়। এসব ফলকে কবির গান, কবিতা, ছড়া ও বাণী তুলে ধরা হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতিগুলো বেদখল হয়ে গিয়েছে। ১৯৬২ কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কুমিল্লার কান্দিরপাড়-ধর্মপুর রেলস্টেশন সড়কের নজরুল এভিনিউ নামকরণ করেন।

শহরের ফরিদা বিদ্যায়তনের পাশে যেখানে প্রমীলা দেবীর বাড়ি ছিল সেখানেও চোখে পড়ার মতো কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। তবে প্রমীলার বাড়ি ও পুকুর পাড় থেকে স্মৃতিফলক উঠিয়ে এনে রাস্তার বিপরীত পাশে ফরিদা বিদ্যায়তনের পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এর অদূরে বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার ছিল, যেখানে কবি কবিতা লিখতেন, আড্ডা দিতেন এর অদূরে কুমিল্লায় নজরুলের একটি স্মৃতিফলক ২০১৫ সালে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে।

শহর থেকে গ্রেফতারের পর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন কবি কিন্তু সেখানেও নেই কবির কোনো স্মৃতিফলক। স্মৃতিফলক নেই কুমিল্লা রেলস্টেশন ও কোতোয়ালি থানায়ও। দক্ষিণ চর্থায় বর্তমান সরকারি হাঁস-মুরগি খামারের পাশে কুমার শচীন দেব বর্মনের যে বাড়িতে বসে কবি সঙ্গীত চর্চা করতেন সেখানে ১৯৮৩ সালের ২৯ আগস্ট নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করার পরও কবি কিংবা শচীন কর্তার স্মৃতি রক্ষায় দীর্ঘ দিন সেই বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের উদ্যোগে তা সংস্কার করা হয়।

কুমিল্লা কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ধরে ৮ কি. মি. সামনে আসলেই কবিতীর্থ দৌলতপুর গ্রাম। এ গ্রামে ঢুকতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়বে ‘নজরুল তোরণ’। তোরণের দুই পাশে ইট-সিমেন্টের তৈরি কালো রঙের টুকরো টুকরো ব্লকে সাদা কালিতে লেখা কবির পংক্তিমালা। ওই পথ ধরে আধা কিলোমিটার ভিতরে গেলেই খাঁন বাড়ি। যে বাড়িটিকে কেন্দ্র করে নজরুলময় হয়ে ওঠেন ভক্তরা।

ওই বাড়ি আর গ্রাম দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত হয়ে ওঠে নজরুল-নার্গিসের গ্রাম হিসেবে। এখানে রয়েছে আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বি-তল বাড়ি। এ বাড়িতেই থাকতেন কবি নজরুল। দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রকার সংস্কার না করায় বাড়িটির পলেস্তার খসে পড়ছে। এ ভবনের পেছনে বাঁশঝাড় পার হলেই কবির বাসর ঘর। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবির বাসরঘরটি আটচালা ছিল। পরে চৌচালা করা হলেও আয়তন ও ভিটির কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

ওই ঘরেই ছিল নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক। অযত্ন ও অবহেলার কারণে সিন্দুকটি কোথায় আছে তা কেউ বলতে পারে না। এক সময় ওই ঘরে বাসর খাটটিও ছিল। সেটি পাশের একটি আধা পাকা ঘরে রাখা হয়েছে। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুপম লীলাভূমি কবিতীর্থ দৌলতপুর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যে নান্দনিক মাত্রা দিয়েছে। এখানেই ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’র ঝংকার বেজেছিল নার্গিসের সুপ্ত ভালোবাসার সংস্পর্শে। এখানেই নার্গিসের ভালোবাসার আগুনের পরশমানিকের ছোঁয়ায় বেজেছিল নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’।

এখানকার সবুজ-শ্যামল পরিবেশ কবিকে দারুণভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। এখানে কবি রচনা করেছেন ১২০টি কবিতা অসংখ্য গান ও ছড়া। কিন্তু সেই দৌলতপুর আজও অবহেলিত ও উপেক্ষিত। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কবির নামে হয়নি কোনো প্রতিষ্ঠান। এমনকি প্রায় দেড়যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত ‘নার্গিস-নজরুল বিদ্যা নিকেতন’ এমপিওভুক্ত হয়নি আজো।

কুমিল্লার এপিপি অ্যাড. এইচটি আহম্মেদ ফয়সাল জানান, কবি নজরুলের নামে দৌলতপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিসহ আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বি-তল বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়ে কবি পত্মী নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক ও বাসরখাটটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

তিনি আরো জানান, প্রতিবছর এখানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাদামাটা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আমরা কবিতীর্থ দৌলতপুরকে রাষ্ট্রীয় ভাবে মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাই।

কবিপত্নী নার্গিস বংশের উত্তরসূরী বাবলু আলী খান জানান, এ বাড়ির পুকুর ঘাটের আমতলায় কবি দুপুরে শীতল পাটিতে বসে গান ও কবিতা লিখতেন। খান বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতেন। পুকুরের পানিতে সাঁতার কাটতেন। শখ করে পুকুরে জাল আর পলো দিয়ে মাছ শিকার করতেন। কবির ওই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য দৌলতপুরে বানানো হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’।

নজরুল-নার্গিস স্মৃতি সংরক্ষণ ফোরামের সভাপতি হুমায়ূন কবীর খান জানান, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর গ্রামে কবির নামে অনেক কিছু হয়েছে। অথচ দৌলতপুরে কিছুই হলো না। কবি দুই মাস ১১ দিন ছিলেন। এখানে তিনি যৌবনে প্রেম ও বিয়ে করেছেন। অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন। দৌলতপুরে কবির নামে বড় ধরনের স্থাপনা ও নজরুল চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দৌলতপুরে-নজরুল নার্গিছের স্মৃতি চিহৃ, বাসর রাতের খাটিয়া সংরক্ষণ, পিকনিক কর্নার তৈরি, নজরুল গবেষণাগার তৈরি করার আশ্বাস ফি-বছর প্রশাসন ও নজরুল প্রেমীদের নিকট থেকে দেয়া হলেও আদৌ এগুলির বাস্তবায়ন হয়নি।

এছাড়াও মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবি তীর্থ আলী আকবর খাঁ বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাঘাট ও নজরুল তোড়নের পাশে কবিতার পংতি লেখার ফলক গুলিরও এখন বেহাল দশা। ওই গ্রামে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল -নার্গিস বিদ্যা নিকেতন সরকারি এমপিও ভুক্তি না হওয়ায় শিক্ষা ব্যস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে মহানগরীর ধর্মসাগর উত্তর পাড়ে বিগত ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজরুল ইনষ্টিটিউটের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উদযাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন এ উপলক্ষে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের উদ্যোগ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে কবি নজরুলের অবহেলিত ওইসব স্মৃতিচিহ্নগুলো সংস্কার ও পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করা হয়।

স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসংলগ্ন রাণীর দীঘির পাড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে যেখানে বসে কবি গান ও কবিতা চর্চ্চা করতেন সেই স্থানটি সংরক্ষণ করে চারপাশে দেয়াল নির্মাণ করা হয় এবং কবির প্রতিকৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কবির স্মৃতি বিজরিত অনেক নিদর্শন এখনো সংরক্ষণের অভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে নেই স্মৃতি ফলক।

এফএ/পিআর