ব্লাস্ট রোগ বাংলাদেশে ধানের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছর আমন ও বোরো মৌসুমে কম-বেশি এ রোগের আক্রমণ দেখা দেয়। কিন্তু এ বছর রোগটির ব্যাপক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক।
Advertisement
চলতি বছরের মার্চ মাসের শুরুর দিকে প্রথম রোগটি দেখা যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায়। পরবর্তীতে রোগটি যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাহদহসহ আশপাশের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে রোগটি দেশের মধ্যাঞ্চল, বিশেষ করে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে দেখা দেয়। মধ্য এপ্রিল থেকে এটি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমিত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বগুড়া, নওগা, গাইবন্ধা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট অঞ্চলে প্রকট আক্রমণের খবর আসছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে আগে ব্লাস্ট রোগ খুব একট দেখা না গেলেও এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
Advertisement
সারাদেশের প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত জনপ্রিয় জাত ব্রি-২৭৮ ধানে এ রোগের আক্রমণ সর্বাধিক। ফলন, গুণগতমান বিবেচনায় স্বল্প জীবনকালের ধানের এ জাতটি কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোরো মৌসুমে দেশের আবাদি ৪১ ভাগ জমিতে এবং আউশ মৌসুমে ২৯ ভাগ জমিতে ব্রি-২৮ এর চাষ হয়। বোরো মৌসুমে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ সম্মিলিতভাবে ৬৫-৬৭ ভাগ জমিতে চাষ হয়।
এ বছর ব্রি-২৮ ছাড়াও ব্রি-২৯, ব্রি-৫০, ব্রি-৬১ ও ব্রি-৬৩ সহ অন্যান্য জাতের ধানেও ব্লাস্টের সংক্রমণ ঘটেছে। তবে উফশি জাতের ধানের মধ্যে ব্রি-৫৮, ব্রি-৬৭, ব্রি-৬৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
সার্বিকভাবে দেশব্যাপী এ বছর বোরো মৌসুমে ধানের উফশি জাতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ প্রকট ছিল। অন্যদিকে হাইব্রিড জাতের ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয়।
Advertisement
পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট এবং শীষ ব্লাস্ট- এই তিন ধরনের ব্লাস্ট রোগের মধ্যে নেক বা শীষ ব্লাস্ট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। পাইরিকুলারিয়া ওরাইজি নামক এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগের বিস্তার ঘটে।
এ বছরে ধানে ব্লাস্ট রোগের মহামারীর জন্য বিশেষজ্ঞরা ওই ছত্রাকের আনুকূল আবহাওয়াকে দায়ী করেছেন। দিনে অধিক তাপমাত্রা, রাতের নিম্ন তাপমাত্রা, আগাম বৃষ্টিপাত, ঝড়ো আবহাওয়া, সকালের কুয়াশা ও শিশির, মৃদু বাতাস, ইউরিয়া সার বেশি ব্যবহার, পটাশ সার কম দেয়াসহ অধিক আদ্রতার কারণে ওই ছত্রাকের প্রকোপ বেড়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
আক্রমণের তীব্রতার কারণে একই গাছে পাতা ব্লাস্ট, গিঁট ব্লাস্ট এবং শীষ ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছে। আগে সাধারণত পাতা ব্লাস্টের প্রকোপ বেশি দেখা গেলেও এ বছর শীষ ব্লাস্টের আক্রমণ ছিল সর্বাধিক। কোথাও আবার নোড বা গিঁট ব্লাস্টের প্রকট আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়।
সাধারণত লিফ ব্লাস্টের আক্রমণে ধান গাছের পাতায় চোঁখের মতো দাগ দেখা যায় এবং আক্রমণের মাত্রা প্রকট হলে অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয়ে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়।
লিফ ব্লাস্টের কারনে পাতায় খাদ্য তৈরি ব্যহত হয়। নোড বা গিঁট ব্লাস্টের কারণে গাছের গিটসমূহে পচঁন ধরে, আক্রান্ত স্থানে গাছটি ভেঙে যায় এবং গিঁটের উপরের অংশ শুকিয়ে যায়।
নেক ব্লাস্টের আক্রমণ ধানের শীষ বের হওয়ার পর পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত শীষের গোড়ায় পঁচন ধরে। ফলে খাবার ও পুষ্টি উপাদান ধানে যেতে পারে না এবং ধান চিটা হয়।
এ রোগের আক্রমণে আক্রান্ত জমিতে শতভাগ পর্যন্ত ফলন বির্পযয় হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নেক ব্লাস্টের কারণে। মূলত নেক ব্লাস্টের আক্রমণ বেশি হওয়ায় এ বছর ধানের ফলনের ব্যপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক তথ্যমতে এ বছর ধানের গড় ফলন বেশ ভালো।
বাংলাদেশে এ রোগের জীবাণুর ১৬৭টি রেস বা প্যাথোটাইপ রয়েছে বলে জানা যায়। ব্রি-২৮ এ রোগ প্রতিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক আক্রমণের ধরন থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, জীবাণুর নতুন প্যাথোটাইপ তৈরি হয়েছে, যা ব্রি-২৮ ধানে আক্রমণ করেছে।
গত কয়েকবছর ধরে ব্যাপকহারে ধানের এ জাতটি অনবরত চাষ করায় এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ে রোগের প্রকৃতি, জীবাণুর ধরন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণের জন্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি যৌথ গবেষকদল খ্যতনামা বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের আক্রান্ত জেলাসমূহ খুলনা, যশোর, ঝিনাহদহ, মেহেরপুর, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা পরিদর্শন করেন।
তারা এ রোগের জীবাণুর প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার জন্য প্রতিটি জেলার তিনটি উপজেলা থেকে আক্রান্ত ও সুস্থ ধান গাছের নমুনা সংগ্রহ করেন। গবেষণা শেষে বোঝা যাব, কোন রোগটি এবার প্রকট আকারণ ধারণ করেছে।
সরেজমিনে খেত পরিদর্শনকালে চুয়াডাঙ্গার এক কৃষক জানান, গত মাসে গরম ও ঝড়ো হাওয়ার পর থেকে এ রোগ দেখা দিয়েছে এবং কয়েকদিনের মধ্যে পুরো খেতে ছড়িয়ে গেছে। ব্রি-২৮ ধানেই এ রোগ বেশি হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবায়ের মাসরুর বলেন, ‘আগামীতে এ রোগ প্রতিরোধে কৃষকদের ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন তাদের জমিতে রোগ কম আক্রমণ হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আক্রান্ত জেলাগুলোতে হাইব্রিড ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রকোপ বেশি থাকলেও উফশি জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ বেশি ছিল। তবে উফশি জাতের মধ্যে ব্রি-৫৮, ব্রি-৬৭, ব্রি-৬৯ ধানে ব্লাস্ট রোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
এছাড়াও ভবিষ্যতে রোগটি প্রতিরোধে ধান কাটার পর নাড়া-খড়কুটো জমিতেই পুড়িয়ে ফেলা, আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ না করা, শোধিত বীজ ব্যবহার করা, অতিরিক্ত পরিমাণে ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা, কয়েক কিস্তিতে ইউরিয়া সার দেয়া, পটাশ সার যথাযথ মাত্রায় ব্যবহার করা, প্রয়োজনে দুই কিস্তিতে পটাস সার দেয়া এবং জমিতে সবসময় পানি ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিবিদরা।
এছাড়া ধানের কুশি অবস্থায় রোগটি দেখা দিলে বিঘাপ্রতি প্রায় পাঁচ কেজি পটাশ সার অতিরিক্ত প্রয়োগ করে সেঁচ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ধানের থোড় আসার পর একবার এবং ফুল আসার পর আবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলেও রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
রোগ প্রতিরোধে ট্রাইসাই কাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- ট্রপার ৭৫ ডব্লিউপি বা জিল ৭৫ ডব্লিউপি প্রতিলিটার পানিতে ০.৮১ গ্রাম অথবা (টেবুকোনাজল ৫০% + ট্রাইফ্লুক্সিট্রোবিন ২৫%) জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন- নাটিভো ৭৫ ডব্লিউপি ১০ লিটার পানিতে ৭.৫ গ্রাম মিশিয়ে বিকেলে স্প্রে করা। অথবা এ রোগের জন্য অনুমোদিত অন্য যেকোনো ছত্রাকনাশক যেমন ফিলিয়া, স্টেনজা, কারিশমা, নোভা প্রভৃতি অনুমোদিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। তবে ধানের নেক ব্লাস্টের জন্য ট্রাইসাই কাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশকের কার্যকারিতা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশষ্য। তাই ধানে যেকোনো রোগ-বালাই সবার মনে শঙ্কা তৈরি করে।
চলতি বোরো মৌসুমে একদিকে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যাজনিত কারণে ফলন বিপর্যয়, অন্যদিকে সারাদেশে রোগ-বালাইয়ের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে অনুকূল আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত দুই বছর বাংলদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গমে ব্লাস্ট রোগ প্রকট আকার ধারণ করে। ফসলকে এসব অনাকাঙ্খিত রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষকদের আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য।
এক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফসলের রোগ সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এখনই ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধানের জাত উদ্ভাবনে উন্নততর গবেষণা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ক্ষতি মোকাবেলায় কৃষকদের সুরক্ষার জন্য শষ্যবীমা কার্যক্রম অপরিহার্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
এসআর/আরআইপি