বিশেষ প্রতিবেদন

চিকুনগুনিয়া নতুন কোনো রোগ নয়

রাজধানীতে সম্প্রতি এডিস মশাবাহী চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ না জেনেই রোগটিকে নতুন রোগ বলে মন্তব্য করেছেন।

Advertisement

সম্প্রতি এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকুনগুনিয়াবাহী এডিস মশা জমে থাকা স্বচ্ছ পানি ছাড়াও ময়লা পানিতেও জন্মে বলে মন্তব্য করেছেন।

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ বহুলাংশে একই রকম হওয়ায় এ দুটি রোগের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি নতুন কোনো রোগ নয়। সাত বছর আগে ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথম রোগী পাওয়া যায়।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উভয় রোগের বাহক এডিস মশা হলেও এ মশার প্রজনন শুধু স্বচ্ছ পানিতেই সম্ভব। ময়লা ও অপরিষ্কার পানিতে জন্মানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।’

চিকুনগুনিয়া রোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি একটি ভাইরাসজনিত জ্বর, যা আক্রান্ত মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। রোগটি ডেঙ্গু ও জিকার মতোই এডিস প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়।’

তিনি আরও বলেন, ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে রোগটি প্রথম দেখা যায়। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ- ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়াতে এর প্রকোপ দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

পরবর্তীতে ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় রোগটি দেখা যায়। তবে এরপর বিছিন্ন দু’একজন রোগী ছাড়া এ রোগের বড় ধরনের কোনো বিস্তার আর বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়নি। বর্ষার পর যখন মশার উপদ্রব বেশি থাকে তখন এ রোগের বেশি বিস্তার ঘটে বলেও তিনি জানান।

Advertisement

চিকুনগুনিয়া টোগা ভাইরাস গোত্রের। মশাবাহিত হওয়ায় একে আরবো ভাইরাসও বলে। ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসও একই মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং একই রকম রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

রোগের লক্ষণ

এ রোগের লক্ষণগুলো হলো- হঠাৎ জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড গিঁটে ব্যথা, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি, বমি বমি ভাব বা বমি, চামড়ায় লালচে দানা ও মাংসপেশিতে ব্যথা।

সাধারণত রোগটি এমনি এমনিই সেরে যায়। তবে কখন কখনও গিঁটের ব্যথা কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।

মশার ধরন

এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এ প্রজাতির মশার শরীরে ও পায়ে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ দেখে চেনা যায়। এ মশাগুলো সাধারণত পরিষ্কার বন্ধ পানিতে জন্মায়। যাদের আশেপাশে এ রকম মশা বৃদ্ধির জায়গা আছে, সেসব মানুষই বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

এ মশা সাধারণত দিনের বেলা (ভোর বেলা ও সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়। এছাড়া চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষার সময় অসাবধানতাবশত এ রোগ ছড়াতে পারে। এ রোগের সুপ্তিকাল তিন থেকে সাতদিন।

এ রোগ প্রতিরোধের কোনো টিকা নেই। তবে ব্যক্তিগত সচেতনতাই প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

প্রতিরোধের উপায়

মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়। শরীরে বেশিরভাগ অংশ ঢেকা রাখা (ফুল হাতা শার্ট ও ফুল প্যান্ট পরা), জানালায় নেট লাগানো, প্রয়োজন ছাড়া দরজা-জানালা না খোলা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করলে এ রোগের হাত থেকে বাঁচা যায়।

এ রোগ থেকে বাঁচতে এসব মশার জন্মস্থান ধ্বংস করা জরুরি। এজন্য আবাসস্থল ও আশেপাশে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা, বাসার আশেপাশে ফেলে দেয়া মাটির পাত্র, কলস, বালতি, ড্রাম ও ডাবের খোসা ইত্যাদি যেসব স্থানে পানি জমতে পারে, সেগুলো ধ্বংস করা। এছাড়া এসব স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সে ব্যাপারেও জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।

রোগ নির্ণয়

উপসর্গ দেখা দিলে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। উপসর্গ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি (সিরোলজি) এবং আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।

চিকিৎসা

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা মূলত উপসর্গভিত্তিক। এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ও চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হবে।

তবে প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পর যদি গিঁটের ব্যথা ভালো না হয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ভালো।

এমইউ/এসআর/এমএআর/এআরএস/এআরএস/জেআইএম