আইন-আদালত

বিচারক নিয়োগে হাইকোর্টের সাত পর্যবেক্ষণ

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সংবিধানে প্রদত্ত চার মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা যাবে না। এমনকি ৪৫ বছরের নীচে এমন ব্যক্তিকে বিবেচনা করা যাবে না।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়েছে।

সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা নিয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের দেয়া রায় প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিমকার্টের ওয়েবসাইটে ৪৬ পৃষ্ঠার এই রায় প্রকাশ করা হয়।

রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতার স্ব-পক্ষে এবং সংবিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা তুলে ধরে বেশ কিছু মতামত দিয়েছেন আদালত।

Advertisement

বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালার জন্য কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে গত ১৩ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে বলা হয়েছে, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সুপারিশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রধান বিচারপতি ইচ্ছা করলে সুপারিশ করার আগে আপিল বিভাগের জেষ্ঠ্য দুইজন এবং হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচারপতির সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রাষ্ট্র বিরোধী বা সমাজ বিরোধী কাজে যুক্ত কীনা সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।

হাইকোর্ট যে সাত দফা পর্যবেক্ষন দিয়েছেন তা হলো-

এক. সংবিধানের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, যেমন- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে। ওই মূলনীতি ও চেতনায় বিশ্বাসী ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা যাবে না।

Advertisement

দুই. বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করার ক্ষেত্রে মেধাবী, প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর পেশাগত যোগ্যতা সম্পন্ন, সৎ এবং আইনি জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে।

তিন. বিচারক হতে আগ্রহী প্রার্থীদের জীবন বৃত্তান্ত সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। এটা দেখার পর ইচ্ছা করলে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সাক্ষাতকার গ্রহণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে পারেন।

চার. বিচারক নিয়োগের সুপারিশের ক্ষেত্রে পেশাগত জীবনে একজন ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে প্রথম বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পেশাগত পরিপক্কতা ও অভিজ্ঞতাকে তার বয়সসীমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের অভিমত হলো-সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়সসীমা সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত।

পাঁচ. বিচারক হিসেবে নিয়োগে সুপারিশ করার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে নিবন্ধিত আইনজীবীদের মধ্য থেকে উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্নদের অগ্রাধিকার দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি। তবে হাইকোর্ট বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন নিবন্ধিত আইনজীবীকেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

ছয়. জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তিন বছরের কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নিম্ন আদালতের কোনো বিচারককে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা উচিত হবে না।

সাত. অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত সততা। তবে মনে রাখা উচিত যে, উচ্চ মেধা সম্পন্ন ব্যক্তির যদি সততা না থাকে তবে তাকে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হলে সেটা হবে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।

সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে উল্লেখিত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন আদালত। ওইদিন শুধুমাত্র আদেশের অংশ ঘোষণা করেন।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালের ৩০ মে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী এ রিট আবেদন করেন। এ রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৬ জুন রুল জারি করা হয়। ওই রুল নিষ্পত্তি করে ১৩ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন আদালত।

এ রুলের পর শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ সাত আইনজীবীকে আদালত বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে নিয়োগ দেন হাইকোর্ট। তারা হলেন-ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি।

এফএইচ/এআরএস/জেআইএম