বিশেষ প্রতিবেদন

বিনিয়োগের পরিবেশ নেই বলেই অর্থপাচার

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদেশে অর্থপাচার ও ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। তার মতে, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই বলেই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নতুন ভ্যাটনীতি এবং আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গেও তিনি কথা বলেন। দুই পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-

Advertisement

জাগো নিউজ : ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ  করছেন অনেকে। আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি? মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : অবশ্যই উদ্বেগ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এক দশক ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২১ কি ২২ শতাংশে আটকে আছে। একটি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশার কথা শোনানো হয় প্রতি বছর। মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। এজন্য প্রবৃদ্ধি অবশ্যই বাড়াতে হবে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অবশ্যই বাড়াতে হবে।

যে পরিমাণ অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা যদি দেশে বিনিয়োগ করা যেত তাহলে প্রবৃদ্ধি অবশ্যই বাড়ানো যেত। বিপুল অঙ্কের অর্থপাচার হওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না এবং কাঙ্ক্ষিত সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না।

জাগো নিউজ : অর্থপাচারের কারণ কী?

Advertisement

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : বিভিন্ন কারণ আছে এবং তা বোঝার জন্য বিভাজনের প্রয়োজনও আছে। একটি হচ্ছে অসাধু উপায়ে অর্জিত অর্থপাচার এবং আরেকটি হচ্ছে সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থপাচার হয়ে যাওয়া। এ দুটোর মধ্যে তফাতও আছে।

দুর্নীতি, চোরাকারবার, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র কেনাবেচা এবং অন্যান্য অপরাধের মাধ্যমে অসৎ উপায়ে উপার্জিত অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ অসৎ উপায় বন্ধ করতে না পারলে অর্থপাচার ঠেকানো যাবে না। পরেরটি হচ্ছে বৈধতার আড়ালে অসৎ পন্থা অবলম্বন করে অর্থপাচার করা। বিনিয়োগের পরিবেশ নেই বলেই অর্থপাচার হচ্ছে।জাগো নিউজ :  জিএফআই যেটি উল্লেখ করেছে…

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : হ্যাঁ। আমদানি-রফতানিতে পণ্যের দাম কম-বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার করা। আইনিভিত্তি নিয়ে ব্যবসা করছেন বৈধভাবে কিন্তু লেনদেন হচ্ছে অবৈধভাবে। ১০ টাকার পণ্য আমদানি করে মূল্য দেখানো হয় ২০ টাকা। তার মানে ১০ টাকা বেশি চলে গেল। বিদেশি পণ্য রফতানিকারকের যোগসাজশে ওই ১০ টাকা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর বাইরের কোনো ব্যাংক হিসেবে জমা হয়ে গেল। আবার একইভাবে রফতানির ক্ষেত্রে ২০ টাকা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করছেন ১০ টাকা। এভাবেই প্রচুর পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ :  এটি তো বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতার ব্যাপার। এমন কৌশলের বিপরীতে কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

Advertisement

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিটি পণ্যের মূল্য দেয়া থাকে। কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটেও মূল্য দেয়া থাকে। এনবিআর বা শুল্ক বিভাগ চাইলে পণ্যের মূল্য যাচাই করতে পারে। সঠিকভাবে মনিটরিং করলে এভাবে পাচার হওয়া অর্থ অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল যা ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

আমরা সবাই জানি, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ অনেকটাই স্থবির অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে এত পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি করে। শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি আনা হলে উৎপাদন বাড়ার কথা। উৎপাদন বাড়াতে হলে কাঁচামালেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ শতাংশের ওপর। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের এ পরিসংখ্যান থেকেই প্রমাণিত হয় দেশ থেকে বড় অঙ্কের অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ :  অর্থপাচারের কারণগুলো…

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : অর্থপাচারের কারণ সবারই জানা। আমরা সবাই এ নিয়ে আলোচনা করি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সন্তোষজনক নয়। এর কয়েকটি কারণ আছে।

প্রথমত, জমির দুষ্প্রাপ্যতা। জমি পেলেও নিবন্ধন নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। দ্বিতীয়ত, জ্বালানির সমস্যা। তৃতীয়ত, অবকাঠামোর সমস্যা। চতুর্থত, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনি জটিলতা। পঞ্চমত, সুশাসন ও দুর্নীতি।

২০০৬ সালের পর নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। পরবর্তী নির্বাচন ঘিরে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। এ অনিশ্চয়তা তো কোনো বিনিয়োগকারীর জন্য সুখ আনতে পারে না। জাগো নিউজ : আর কোনো কারণ?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এখন একটি বড় সমস্যা। গুলশানের হলি আর্টিসানের ঘটনার পর আর হয়তো বড় কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জঙ্গি ইস্যু ঘটনার ধারাবাহিকতা রয়েই গেছে।

প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটছে। পুলিশ হয়তো অভিযান চালিয়ে সামাল দিতে চাইছে। কিন্তু জনমনে তো শঙ্কা আছে। সব মিলিয়ে বলতে হয়, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। এ কারণে যারা সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করছেন, তারাও অসৎ উপায়ে অর্থ বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন। অর্জিত অর্থের নিরাপত্তার জন্যই এ কৌশল।

জাগো নিউজ : এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেও তো উন্নয়ন হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটি অস্বীকার করা যায় না। যেমন- জঙ্গিবাদ ইস্যুতে সরকার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একইভাবে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে নানা উদ্যোগের কথা সামনে আসছে। জ্বালানির সমস্যা সমাধানেও নানা চেষ্টা দেখছি।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উদ্যোগগুলো কবে বাস্তবায়িত হবে- তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের রেকর্ড খুব সন্তোষজনক নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের কথা আমরা সবাই জানি। প্রতিটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে। এতে সময়ের পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয়ও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যে সমস্যাগুলোর কথা আলোচনা করা হলো, তার সমাধান না হলে দেশে কোনো বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে না।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি