রূপগঞ্জের কাঞ্চন মশারি পল্লীর তৈরি মশারির সারা দেশে রয়েছে বিশেষ সুখ্যাতি। এই সুবাদে রূপগঞ্জের মশারি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। মশারি পল্লী ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক মশারি তৈরির কারখানা। অনেকেই এ ব্যবসা করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক মানুষের। ১৯৬৪ সাল থেকে রূপগঞ্জে মশারি তৈরি শুরু হয়। জামদানি তৈরির শিল্পীরা চিকন সুতা দিয়ে বাতাস আসা-যাওয়ার ফাঁক রেখে প্রথমে মশারি তৈরি শুরু করেন। সেই থেকেই রূপগঞ্জের মশারি সারা বাংলাদেশে সমৃদ্ধ। প্রথম অবস্থায় সুতি ও পপলিন, টেট্রন সুতা দিয়ে মশারি তৈরি শুরু হয়। আস্তে আস্তে এ মশারি আধুনিক রূপ নেয়। একসময় এ মশারি চলে আসে তাঁত শিল্পের অধীনে। রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ হওয়ার পর থেকে বাড়তে থাকে মশারির চাহিদা। তাঁতিরা কাপড় বোনা ছেড়ে জড়িয়ে পড়েন মশারি তৈরিতে। আর এ মশারির এখন সারাদেশে। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রফতানি হচ্ছে মশারি। রূপগঞ্জে প্রথম মশারি উৎপাদন শুরু হয় কাঞ্চনের রানীপুরা এলাকায়। এরপর আস্তে আস্তে নোয়াপাড়া, কেন্দুয়া, কলাতলী, কালাদী, চৌধুরীপাড়া, পেরাব, ভুলতা, গোলাকান্দাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে মশারি তৈরির কারিগররা। স্বাধীনতার আগেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দু`ধারে শত শত লোক মশারি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁত শিল্পে মশারির বুনন শুরু হলে রূপগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকাগুলো কাপড় বুনন বাদ দিয়ে চলে যান মশারি বুননে। লাভও হতো প্রচুর। নারায়ণগঞ্জ একসময় বাংলাদেশের সুতা বিক্রয়ের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁতিরা এখান থেকে সুতা কিনে নৌকাযোগে নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে তৈরি করতেন মশারি। আধুনিক ছোঁয়ায় সেই তাঁতের মশারি এখন প্রায় বিলুপ্ত। স্থানীয় তাঁতিরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন নেট মশারি তৈরি করছেন। ৮০ থেকে ৯০-এর দশকে রূপগঞ্জের মশারি সারাদেশে ব্যবহার হতো। সেই সময়ই মশারি তৈরি একের পর এক কারখানা তৈরি হতে থাকে রূপগঞ্জের আনাচে কানাচে। বর্তমানে রূপগঞ্জে প্রায় দেড় শতাধিক মশারি উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ পিস মশারি তৈরির কাপড় উৎপাদন করে মশারি তৈরি করছে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। গত অর্থবছরে রূপগঞ্জের ভুলতা-গাউছিয়া এলাকা থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মশারি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। রূপগঞ্জের মশারির কদর ভারতে ব্যাপক। প্রতি বছর শত শত ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ভুলতা গাউছিয়া মার্কেটের মশারিপট্টি থেকে হাজার হাজার পিস মশারি কিনে ভারতে নিয়ে বিক্রি করছেন। একদিকে যেমন পাচ্ছে সরকার রাজস্ব, অন্যদিকে মশারি শিল্পে এসেছে সুদিন। রূপগঞ্জের মশারি তৈরির কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে তাদের রমরমা অবস্থা। দিন-রাত শ্রমিকরা মশারি তৈরির নেট কাপড় তৈরি করছেন। এসব কাপড় স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে ৩ হাত, ৪ হাত, ৫ হাতসহ বিভিন্ন সাইজের মশারি তৈরি করে তাদের গোডাউনে গুদামজাত করছেন। মশারি তৈরির প্রক্রিয়া জানতে গিয়ে জানা যায়, একটি মশারি তৈরি করতে ৫ থেকে ৮ পাউন্ড সুতার প্রয়োজন হয়। যার মূল্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। একটি মশারি তৈরির কারিগরকে দিতে হয় ৮ টাকা। সেলাইয়ের সুতা, লেইসসহ বিভিন্ন ডায়িং ফ্যাক্টরিতে ডায়িং করে নানা রঙের ছাপা দিয়ে একটি মশারি তৈরি করতে খরচ হয় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। ৩, ৪ ও ৫ হাত একটি মশারি বাজারে বিক্রি হয় ২০০ টাকা থেকে ২২০ টাকার মতো। ফলে মশারি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় বিভিন্ন শিল্প মালিকরা ব্যবসার পাশাপাশি তৈরি করছেন মশারির কারখানা। একসময় রূপগঞ্জে মশারির তাঁতিরা নরসিংদী, শেখেরচর, ঢাকার সদরঘাট, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনায় মশারি বিক্রি করলেও রূপগঞ্জে মশারি শিল্প কারখানা বাড়তে থাকায় রূপগঞ্জেই তৈরি হয় মশারির বাজার। ভুলতা গাউছিয়া মার্কেটে মশারি ব্যবসায়ীরা ৬শ` দোকান নিয়ে তৈরি করেছেন মশারির হাট। প্রতি মঙ্গলবারের পাশাপাশি সপ্তাহের প্রতিদিনই এখান থেকে ট্রাক বোঝাই করে ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে মশারি সরবরাহ করছেন। `মশারি তৈরির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, আরও চমকপ্রদ তথ্য। ১৯৬৫ সাল থেকে কাঞ্চনে শুরু হয় মশারি তৈরি। ওই সময় গিয়াসউদ্দিন, কফিলউদ্দিন, আফিলউদ্দিন নামে ৩ জামদানি তাঁতি নিজ প্রচেষ্টায় তৈরি করেন চারকোণা বিশিষ্ট একটি বস্তু। মশার কামড় থেকে বাঁচতে এ বস্তুটির ভেতর কফিল উদ্দিন রাতযাপন করেন একদিন। আধুনিক সভ্যতায় মশা কামড়ালে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া রোগ হলে ওষুধ সেবন করে সুস্থ হলেও ওই সময় এসব ওষুধ উৎপাদন বাজারজাত কিছুই ছিল না। মশার কামড়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে গ্রামাঞ্চলে মানুষজন রোগে ভুগে মারা যেতেন। ওই মশারি ব্যবহারে আফিলউদ্দিন এ ধরনের রোগ থেকে মুক্ত থাকেন। সেই থেকেই কাঞ্চন এলাকার লোকজন নিজেদের রক্ষার জন্য মশারি ব্যবহার শুরু করেন। আর এ মশারি এখন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে এ মশারি তৈরি হওয়ার পর অবাধে মশারি যেতে থাকে ভারতে। আর তৎকালীন সময় ভারত এ মশারি দেখে স্বাধীন ভারতের জনক মাহাত্মা গান্ধী আফিল উদ্দিনকে শ্রেষ্ঠ উৎপাদক হিসেবে পদক দিয়ে ভূষিত করেন। আফিল উদ্দিন না থাকলেও তার পরিবারের লোকজন এখনও জড়িয়ে আছেন এ মশারি ব্যবসার সঙ্গে। সেই সময়ের মশারি ব্যবসা এখন আর নেই। হাতে ও তাঁতে বোনা মশারি এখন আর তৈরি না হলেও নেটের মশারি তৈরি হচ্ছে রূপগঞ্জে। মশারি তৈরির পল্লী ও গাউছিয়া মশারি মার্কেট ঘুরে জানা যায়, মশারি তৈরি করে রূপগঞ্জে এখন অনেকেই কোটিপতি। একসময় ৪/৫টি কারখানায় নেট মশারির কাপড় তৈরি হতো। সেখান থেকে কাপড় কিনে এনে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেলাই মেশিন দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৮/১০টি মশারি তৈরি করে বাবুরহাটে নিয়ে খুচরা বিক্রি করতেন। লাভও হতো মোটামুটি ভালো। আস্তে আস্তে ওই ক্ষুদ্র মশারি তৈরির কারিগররা ব্যাংক লোন, জমি বিক্রি করে ছোট আকারে মশারির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম অবস্থায় একটি জাপানি মশারি তৈরির মেশিন (লুম) ৬০/৭০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করে তৈরি করতে থাকেন মশারি তৈরির কাপড়। আধুনিক সভ্যতা ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে জাপানসহ বিভিন্ন দেশে তৈরি করছে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার মশারি তৈরির মেশিন। যা রূপগঞ্জে রয়েছে এই দামের কয়েকশ` মেশিন। ক্ষুদ্র তাঁতিরা এখন অনেকেই শিল্পপতি হয়েছেন এ মশারি ব্যবসা করে। রূপগঞ্জের মশারি বিভিন্ন এলাকায় রফতানি হতে থাকলেও একের পর এক স্থাপিত হতে থাকে মশারি তৈরির কারখানা। এর মধ্যে ফ্যামকন নিটিং, এসআর নিটিং, মাজেদা নিটিং, ঢাকা নেট, মোতালিব নিটিং, কেয়া নিটিং, এসএস নেট, আলম নিটিং, বাবুল নিটিংসহ অর্ধশতাধিক মশারি তৈরির কারখানা রয়েছে রূপগঞ্জে। দেশের ৮০ ভাগ মশারি তৈরির কারখানাই রূপগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত। এসআর নিটিং-এর মালিক আব্বাস উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, প্রথম অবস্থায় অল্প পুঁজি নিয়ে ৫/৭ জন কারিগর দিয়ে মশারি তৈরির ব্যবসা শুরু করলেও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে আমার ব্যবসার পরিধি। বর্তমানে এসআর নিটিং নাম দিয়ে জাপানি পাওয়ার লুম দিয়ে তৈরি করছি মশারি। মাজেদা নিটিং-এর মালিক নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি রূপগঞ্জে মশারি ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় তৈরি করি মশারি তৈরির কারখানা। দেশের শীর্ষস্থানীয় কেয়া গ্রুপের কেয়া নিটিং নামে মশারি তৈরির কাপড়ের মিলটি তৈরি হয়। থ্রি-স্টার মিলের মালিক আবদুল করিম জাগো নিউজকে জানান, রূপগঞ্জের এ মশারি দেশের অভ্যন্তর ছাড়া ভারত, বার্মা, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রূপগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেট থেকে রফতানি হচ্ছে। লাভও হচ্ছে প্রচুর। প্রতি বছর রূপগঞ্জ থেকে প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার মশারি বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়।মীর আব্দুল আলীম/এমজেড/আরআইপি
Advertisement