ইদানিং তো পত্রিকা খুলতেই ভয় হয়। সকালটাই শুরু হয় বনানীর ধর্ষণ আর আপন জুয়েলার্সের সংবাদ দিয়ে। নিজের অনলাইন পত্রিকায় চাকরির সুবাদে বলা যায় সারাদিন কেটে যায় এই এক ঘটনার ফিরিস্তি দেখতে দেখতে। জানি না এই ইস্যু আর কতদিন চলবে আর কবেই বা নতুন কোনো ইস্যু আসবে। কে জানে সেটা আরও কতটা ভয়ঙ্কর হবে।
Advertisement
বনানীর ঘটনায় গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সত্যিই প্রসংশনীয়। বোঝাই যাচ্ছে অপরাধী যেই হোক না কেন, যত প্রভাবশালীই হোক না কেন আইন সবার জন্যই সমান। অন্তত গত কয়েক দিনে বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় আমরা এটাই দেখতে পারছি। তবে ইদানিং একটা প্রশ্ন প্রতিদিন আমার বিবেককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। আর সেই প্রশ্নটি হলো আমরা কি তাহলে আয়শাকেও ভুলে গেলাম? আয়শার কথা মনে আছে তো… ওই যে ওই মেয়েটা যাকে এলাকারে এক বখাটে জানোয়ার ধর্ষণ করলো। বেচারি আয়শার রিকশাচালক বাবা শেষমেষ বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিল। এ তো গেল কেবল একটা ধর্ষণের ঘটনা। প্রতিদিনই অন্তত একটা ধর্ষণের সংবাদ আমার হাত দিয়ে প্রকাশিত হয়, যার কিছু থাকে অত্যন্ত ভয়াবহ। এটা যেন আজ-কালকার একটা দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
মানুষরূপী জানোয়ারগুলো যেন থামছেই না। আর থামবেও না। আমি বলি থামবেই বা কেন? ইস্যুর তো আর শেষ নেই, একবার নতুন ইস্যু এসে গেলেই ব্যস সব ঠিকঠাক। জানোয়ারগুলোও এই সুযোগে নতুন কোনো শিকার খুঁজে নেয়। তারপর আবারও ধর্ষণ, কিছুদিন ধর্ষিতার পরিবারের সঙ্গে মিমাংসার চেষ্টা, চাপ প্রয়োগ, হুমকি-ধামকি, কাজ না হলে গা ঢাকা অতঃপর নতুন ইস্যু। আর ইস্যু যদি হয় রাজধানী কেন্দ্রিক তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। কিন্তু কেন এমনটা হয়। রাজধানীর বাইরে একটি ধর্ষণ কিংবা একটি হত্যাকাণ্ড কেবল একটা হেডলাইন হয়েই থেকে যায় কেন? আমি বনানীর ঘটনায় ধর্ষকদের পক্ষে না। থাকার প্রশ্নও উঠেনা। বরং এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে আজ যা হচ্ছে তা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। আর এ ঘটনায় সত্যিই যদি দ্রুত ধর্ষকদের যথাযোগ্য শাস্তি হয় তাহলে তা অবশ্যই একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে এবং ধর্ষকরাও তাদের কর্মকাণ্ড ঘটানোর আগে ১০০ বার ভাববে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে এই উদাহরণ, এত মিডিয়া কাভারেজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত তৎপরতা কেবল এই এক বনানীর ঘটনায় কেন? কেন একটি মফস্বলের কিংবা অজো পাড়াগায়ের কোনো নারী বা শিশুর জন্য নয়?
নারী ও কন্যা শিশুদের উপর নির্যাতনের বাৎসরিক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ১০৫০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সেদিন কোনো একটা লেখায় দেখলাম, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩২৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ৩২৫ শিশুর মধ্যে ৪৮ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার, ৩১ জন প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ও ৫ জন গৃহকর্মী শিশু। এদের মধ্যে ১৫ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে ২০১৫ সালে ১৪১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর আগে এই সংখ্যা ছিল ২০১৪ সালে ১১৫, ২০১৩ সালে ৯৩ ও ২০১২ সালে ৮৫। এগুলো তো গেল বিগত কয়েক বছরের ঘটনা। কিন্তু ২০১৭ সবে শুরু। নতুন বছরের বয়ে যাওয়া ৫ মাসের সংবাদগুলো কী এই বলে না যে বছর শেষে বার্ষিক ধর্ষণের প্রতিবেদন কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে?
Advertisement
আজ ঘরে ঢুকে শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, খেলতে গেলে তাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। হায়রে সে একটা শিশু। জীবন, জগত কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে দেখতে হচ্ছে সুন্দর পৃথিবীর সব থেকে জঘন্য রূপ। অনেক সময় এর মূল্য দিতে হচ্ছে প্রাণ দিয়ে। বিনিময়ে মফস্বলে কয়টা ধর্ষণের ঘটনায় দোষী ব্যক্তির শাস্তির খবর আমরা পেয়েছি? সংখ্যাটা কি একেবারেই কম নয়? এক বনানীর ঘটনাটি সবার নজরে এসেছে তাই এখানে তৎপরতাও বেশি, কিন্তু এটা কি আমাদের দায়িত্ব না যে সব ধর্ষণের ঘটনাতেই এভাবে তৎপরতা দেখানো। আজ এক বনানী যদি পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে প্রতিদিনের সারাদেশের ধর্ষণের ঘটনায় একসঙ্গে তৎপরতা দেখালে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে বিষয়টি ভাবা উচিত। বিন্দু বিন্দু বালু দিয়ে মহাদেশ গড়ে তোলার সময় এটাই কি নয়?
লেখক : সহ-সম্পাদক, জাগো নিউজ।
এইচআর/আরআইপি
Advertisement