বিশেষ প্রতিবেদন

কাজে আসছে না বিনিয়োগ পরিকল্পনা, ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকা

গত পাঁচ বছরে দেশের অবকাঠামো খাতে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বদলায়নি বিনিয়োগের চিত্র। কোনোভাবেই বিনিয়োগের খরা কাটছে না। প্রতি মাসেই কমছে নিবন্ধন। এভাবে টানা কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগের দুর্দিন চলছে।

Advertisement

সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগের পরিমাণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবায়নের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য অনুকূল পরিবেশের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, জমি রেজিস্ট্রেশন, ঋণের সুদের হার, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানীমূলক চার পর্বের নিবন্ধের শেষ পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-

সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ৮ শতাংশ জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে জিডিপিতে ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ বিনিয়োগ বিদ্যমান। তাই স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বরাবরই হা-হুতাশ করছে বাংলাদেশ।

Advertisement

বিপুল আগ্রহ নিয়ে বিনিয়োগ করতে এসে এ দেশের নানা আইনি-বেআইনি ব্যবস্থার জটিলতায় পড়ে ফিরে যেতে হচ্ছে বিদেশিদের। সস্তাশ্রম ও ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে জিএসপি সুবিধার হাতছানিতে ছুটে আসা বিদেশি ব্যবসায়ীদের বিমুখ হতে যেন সময় লাগে না।

খোদ অর্থ বিভাগ বলছে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণের নীতি ও কৌশল কাজে আসছে না। সরকার থেকে সব ধরনের নীতি ও কৌশলগত সহায়তা দেয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। এতে হতাশা প্রকাশ করেছে অর্থ বিভাগ।

এ অবস্থায় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ। বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় দেশের ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পাহাড় জমছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য অর্থাৎ বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাটানো যাচ্ছে না। ফলে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগে কেউ এগিয়ে আসছে না। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগে পুঁজির নিশ্চয়তা চান। কিন্তু তা না পাওয়ায় পুঁজি হারানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যার প্রভাবে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। এজন্য সরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন তারা।

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে এক ধরনের শ্লথগতি বিরাজ করছে।

অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে জমছে অলস অর্থ। আবার বিতরণকৃত ঋণ সঠিক সময়ে ফিরে না আসায় এবং সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিতে না পারায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের তৈরি করা একটি সারসংক্ষেপে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় নয় বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার সময় দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে সেই বিনিয়োগ মাত্র দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ।

অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে আগামীতে টানা ২৬ বছর ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। এটি দেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিই সরকারের রয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

সম্প্রতি সচিবালয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন সব ধরনের কৌশল হাতে নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা প্রায় কেটে গেছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ বাড়বেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় ব্যাংকে জমেছে অলস টাকার পাহাড়। ২০১৫ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যেও আমানতের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রেখে মুনাফা করেছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর মুনাফা হলেও প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগ করতে না পারায় দেশে যেমন কর্মসংস্থানের হার বাড়ছে না, তেমনি সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরাজ করছে এক ধরনের স্থবিরতা। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের গতিধারা স্বাভাবিক থাকায় গত অর্থবছর ৭ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

এমইউএইচ/এমএআর/জেআইএম