মতামত

উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি এড়াতে সচেতন হোন

একটা সময় ছিলো যখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সংক্রামক রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, যক্ষা ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব ছিলো ভয়াবহ মাত্রার। ডায়রিয়া এবং কলেরাতে এত মানুষ মরতো যে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ উজাড় হয়ে যেতো। বলা হতো, গ্রামে মড়ক লেগেছে। এমন সময়ও নাকি আসতো যে, কেউ মারা গেলে শেষকৃত্য বা জানাজা পড়ার লোকও খুঁজে পাওয়া যেতো না! আর, যক্ষা সম্পর্কে বলা হতো “যার হয়েছে যক্ষা, তার নেই রক্ষা”। যক্ষা মানেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। এছাড়া প্লেগ, গুটি বসন্ত, হুপিংকাশি, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধিতে প্রচুর মানুষ মারা যেতো। যদিও, আফ্রিকা মহাদেশে এখনও ম্যালেরিয়া তার উদ্যত ফণায় ব্যাপক মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে চলেছে। তবে, এটা ঠিক, বিশ্বব্যাপী মানুষের সচেতনতা, টিকাদানে সফলতা-এসব কারণে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকখানি কমেছে। বিশ্বব্যাপী গুটিবসন্ত তো এখন জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। আর পোলিও ঠাঁই নেয়ার পথে।

Advertisement

এ যদি হয় সফলতার দারুণ এক পিঠ তাহলে সে অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রার উল্টো পিঠে দেখা দিয়েছে অসংক্রামক রোগের ভয়ংকর বিস্তার। কি উন্নত আর কি অনুন্নত-সবদেশেই এ অসংক্রামক রোগের মাত্রা এখন ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার নামক অসংক্রামক রোগ চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আশার ব্যাপার হচ্ছে, সচেতন হলে এসব রোগ বা রোগজনিত জটিলতা থেকে সহজেই নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই আসুন, নিজে সচেতন হই; অন্যকেও সচেতন করি।

সচেতনতার সে লক্ষ্যকেই সামনে রেখেই আমাদের দেশের মতোই বিশ্বব্যাপী ১৭ মে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালিত হয়ে থাকে। যেহেতু একমাত্র সচেতনতাই পারে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি এড়িয়ে এ সংক্রান্ত জটিলতার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সেহেতু এ দিবস পালনের তাই বিস্তর গুরুত্ব রয়েছে।

নিজে বা পরিচিতজন- যারই উচ্চ রক্তচাপ থাকুক না কেন; আমরা সেটা বোঝাতে খুব সাদামাঠাভাবেই বলে থাকি যে,  আমার বা উনার তো প্রেশার (রক্তচাপ) আছে! খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রেশার সকল মানুষের দেহেই বিদ্যমান আছে। প্রশ্নটা হচ্ছে, সেটা  স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি কিনা! যদি বেশি থাকে তাহলেই তা উচ্চ রক্তচাপ ( যাকে আমরা শুধু প্রেশার বলছি!) হিসেবে বিবেচিত হবে। আর স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরে থাকলে তা স্বাভাবিক রক্তচাপ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি যে, অনেকে বলে থাকেন যে, তিনি “লো প্রেশারে” ভুগছেন। এটা একদম ভুল ধারণা মাত্র। মনে রাখতে হবে, যিনি স্বাভাবিকভাবে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করছেন, শারীরিক কোন সমস্যা নেই তার জন্য (যাকে উনি “লো প্রেশার” বলছেন) সেটাই আসলে স্বাভাবিক প্রেশার। ব্লাড প্রেশারের ক্ষেত্রে বয়স, ব্যক্তি এবং লিঙ্গভেদে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়া অস্বাভাবিক নয় মোটেও।

Advertisement

এখন আসুন জেনে নিই, ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ আসলে কি জিনিস, কখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলি, কি কারণে এমন হয় আর কিভাবেই বা  সচেতনতার মাধ্যমে তা ঠেকানো যায়।

রক্তচাপ হচ্ছে, রক্ত তার চলার পথে রক্তনালীর উপর যে পার্শ্বচাপ প্রয়োগ করে সেটা। প্রেশার মাপার যন্ত্র দিয়ে এ প্রেশার যে মাপা যায়; সেটা আপনারা দেখছেনও বটে। অনকেই হয়ত জানেন, রক্তচাপের গড়পড়তা স্বাভাবিক  সর্বোচ্চ সীমা হচ্ছে ১২০/৮০ মিমি মার্কারি। যদি কোন অবস্থায় তা ১৪০/৯০ মিমি মার্কারি এর বেশি হয় তাহলে সেটা উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে গণ্য হবে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে,যদি ১২০/৮০ এর বেশি কিন্তু ১৪০/৯০ এর নিচে থাকে তাহলে তাকে আমরা কি বলব? উত্তর হচ্ছে, উক্ত ব্যক্তি প্রি-হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ শুরু হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে একটু সচেতন হলেই কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করা একদমই প্রায় সম্ভব হয়। 

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি? আর নিয়ন্ত্রণে না রাখলেই বা  কি কি ক্ষতি হতে পারে? উত্তর হচ্ছে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি জটিলতাসহ অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। নিশ্চয় আপনারাও অনেকে জেনে থাকবেন যে, উক্ত রোগগুলো কি পরিমাণে ভয়াবহ এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটানোসহ মৃত্যুঝুঁকি বা শারীরিক জটিলতা তৈরি করতে পারে। দয়া করে, একটু আশেপাশে তাকান। তাহলেই আপনার পরিচিত নিকটজনের ভেতরেই হয়ত উচ্চ রক্তচাপজনিত দুর্ঘটনা বা জটিলতার হৃদয় বিদারক খবর শুনতে পাবেন! এ জটিলতাসমূহ এড়াতেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা তাই ভীষণ জরুরি।

আমাদের দেশে ঠিক কত শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবুও বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস রিস্ক ফ্যাক্টর সার্ভে বাংলাদেশ, ২০১০-এ দেখা যায়, হৃদরোগের অন্যতম বড় কারণ হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ এবং এ জরিপ বলছে, শহরে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ আর গ্রামে তা প্রায় ১৮ শতাংশ। অন্য একটা গবেষণা বলছে, আমাদের দেশে বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৪৪.৮ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ভারতে ব্লাড প্রেসারে ভুগছেন এ রকম রোগীর সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল ১৪০ মিলিয়ন যা ২০১৯০ সালে  ২১৫ মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে! কেমন আগ্রাসী এটা তাহলে একবার ভাবুন!

Advertisement

উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার পেছনে কারণ কি? উত্তর হচ্ছে, খাবারে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, কায়িক পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত তেল ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ, মানসিক উত্তেজনা, বয়স বৃদ্ধি, পারিবারিক ইতিহাস, শরীরের ওজন বৃদ্ধি, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি কারণে রক্তচাপ ধীরে ধীরে বা এমনকি হঠাৎও বেড়ে যেতে পারে। এগুলো হচ্ছে প্রাইমারি হাইপারটেনশনের কারণ। তবে কিছু রোগের জন্যও রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে যাকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন বলে।

মনে রাখতে হবে, রক্তচাপ বাড়লে অধিকাংশ সময়ই শারীরিক তেমন কোন অসুবিধা কিন্তু পরিলক্ষিত নাও হতে পারে। তবে, অনেকেই (সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদগ্ধ জনও) মনে করে থাকেন যে, প্রেশার বেড়ে গেলে ঘাড়ে ব্যথা হয় বা বা ঘাড়ে ব্যথা হলে প্রেশার বেড়েছে এমনও ভেবে থাকেন। এবং সে ধারণার বশবর্তী হয়ে তেঁতুল গোলানো পানি পান করেন বা টক জাতীয় খাবার খান। এতে নাকি উচ্চ রক্তচাপ কমে স্বাভাবিক হয়ে যায়! আসলেই কি তা হয়? উত্তর হচ্ছে , রক্তচাপ সেভাবে কমে না। তবে, কিছু একটা তো করেছি; মনে করে যে মানসিক প্রশান্তি লাভ  হয় সেটা হয়ত রক্তচাপ অল্পস্বল্প কমালে কমাতেও পারে।  তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কিন্তু কমে না।

অনেকে আবার অপচিকিৎসার সর্বোচ্চ উপায় বেছে নিয়ে অমন অবস্থায় এক ডোজ রক্তচাপ কমানোর ওষুধ খেয়ে থাকেন। এটা একবার নয় । বারবার করেন। ঘাড় ব্যথা হলেই করেন। এটাও খুবই ভ্রান্ত ধারণা। অনেকে আবার প্রেশার বেড়ে গেলে চিকিৎসকের দেয়া ওষুধ খান। কমে গেলে বন্ধ করে দেন। এটা যে কি রকম ভয়াবহ  ব্যাপার তা বলে বোঝানো যাবে না! প্রেশার না মেপে এবং চিকিৎসকের পরামর্শব্যতীত  কোন ওষুধ খাওয়া যেমন  অবিবেচকের কাজ তেমনিভাবে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ অনিয়মিতভাবে গ্রহণ করাও রীতিমতো পাগলামির সমতুল্য। এটা প্রথমটার চেয়ে আরো বেশিমাত্রায় ভয়াবহ। এমন কাজ তাই কখনোই করবেন না।

মনে রাখবেন, উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধযোগ্য একটা অসুখ। যদি সচেতন হন তাহলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অথবা উচ্চ রক্তচাপজনতি দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা সহজ হয়। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এ কারণে, আসুন ৩৫ বৎসরের উপরে বয়স হয়ে গেলে নিয়মিত ( সপ্তাহে অন্তত ১দিন) রক্তচাপ মাপি। প্রয়োজনে রক্তচাপ মাপা মেশিন কিনে ঘরে রাখতে পারেন। ইচ্ছেমতো প্রেশার মাপতে পারেন এবং তা লিখেও রাখতে পারেন। সে  রেকর্ড প্রয়োজনে চিকিৎসক কে দেখান এবং তা দেখে চিকিৎসক সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যে আপনি আসলেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কি ভুগছেন না।

উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি এড়াতে তাই খাবার তালিকা থেকে তেল, চর্বি জাতীয় খাবার এবং খাসি ও গরুর মাংস বাদ দিন। লবণ কম খান। নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করুন। যদি বাসায় ফিরে ব্যায়াম করার সুযোগ কম থাকে তাহলে বাসা থেকে অন্ততঃ ১ কিমি দূরে বাস বা ব্যক্তিগত গাড়ি হতে নেমে পড়ুন। হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরুন। অফিসে পারলে লিফট এ ওঠা বাদ দিন। চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার কম খান। কোল্ড ড্রিংকস, তেলে ভাজা খাবার, আচার, চিপস এগুলো খাবার তালিকা থেকে বাদ দিন। শাকসবজি বেশি করে খান। প্রয়োজনমতো পানি পান করুন। জীবনযাত্রা নিয়মিত করুন। নিয়মমতো ঘুমান। পারলে যোগ ব্যায়াম করুন। তাহলে মানসিক উত্তেজনা কম হবে। ঘুমও ভালো হবে। আর আবারও বলছি, প্রেশারের ওষুধ খাওয়া শুরু করলে তা চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কখনোই বন্ধ করবেন না। অনিয়মিত প্রেশার ওষুধ খেলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে বাধ্য।

তাই আসুন হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি ফেলইওর বা অন্ধত্ব নামক  ভয়াবহ জটিলতা থেকে বাঁচতে রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখি এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি এড়িয়ে চলি।  এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ানোর তাই কোন বিকল্প নেই।

লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/আরআইপি