প্রথম দিনের ক্লান্তি শেষে ২য় দিনের যাত্রা শুরু করলাম। অলংকার মোড় থেকে আবার মিনিবাসে উঠে সীতাকুণ্ড ইকো পার্কের গেটের সামনে নামলাম। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকেই হাতের ডানপাশে পড়লো একটি পার্ক। ছোট্ট কিন্তু সাজানো গোছানো। এখানে আর কালক্ষেপণ না করে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।
Advertisement
পিচঢালা পাহাড়ি পথ, রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে খুব পরিষ্কার ছিল রাস্তাটা। কিছুদূর যাওয়ার পরেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। পিপাসা পাচ্ছিল, তাই সঙ্গে থাকা বোতলজাত পানি পান করে তৃষ্ণা মিটাচ্ছিলাম। কিছু সময় পর দেখলাম, একটা পাকা নোটিশ বোর্ড টানানো। তাতে লেখা ছিল ‘সুপ্তধারা ঝরনা ডান দিকে’। আমরা ভেবেছিলাম খুব কাছেই হবে। ডানদিকে থাকা সিঁড়ি ধরে নামতেই মনে হচ্ছে- এই পথ তো আর শেষ হচ্ছে না। প্রায় ১২শ’ ফুট নিচে নামতে হবে ভেবেই যতটা ক্লান্তি চলে আসছিল; তার চেয়ে বেশি ভয় লাগছিল কীভাবে আবার এই ১২শ’ ফুট উপরে উঠবো?
যা হোক, এই সিঁড়ির ভয়ে জাকির, জুয়েল আর লুৎফর আমাদের সঙ্গে না গিয়ে উপরেই থেকে যায়। আমরা নিচে চলে আসলাম কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এখন হাঁটতে হবে ঝিরি পথে। কমপক্ষে ৪০ মিনিট হেঁটে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা সেই জোঁকের ভয় পাচ্ছিলাম। কখনো অনেক গভীর খাদ ঝিরি পথটাতে। আগের রাতের পাহাড়ি ঢলে পানির পরিমাণটাও বেশি।
হাঁটতে হাঁটতে একটা কাঙ্ক্ষিত শব্দ কানে আসছিল আর আমাদের মনেও শান্তির হাওয়া বইতে শুরু করছিল। ডানদিকে বাক নেওয়ার পরেই দেখতে পেলাম সেই মনের সুপ্ত বাসনার মতো সুপ্তধারা ঝরনা। ঝরনার নিচে বড় বড় পাথরগুলো ঝরনার সৌন্দর্য যেন শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্যান্য ঝরনার চেয়ে এটার পার্থক্য ছিল। এ ঝরনার পানি চার ভাগে পড়ছিল। দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো একটি ঝরনা। বেলা বেশি না হওয়াতে গা ভেজাতে পারলাম না। ঝরনার নিচে বসে থেকে ঝরনার আকুতি শুনছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল- কেন পানি চার ভাগে পড়ছে?
Advertisement
যা হোক- ফিরে আসতে হবে, সহস্রধারায় যেতে হবে। তাই বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল- কী যেন রেখে যাচ্ছি। তবুও এগিয়ে যাচ্ছি সেই ঝিরি পথ ধরেই। সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে যখনই উঠলাম; তখনই বাধলো বিপত্তি। উপরে জাকির আর লুৎফরকে রেখে গিয়েছিলাম কিন্তু এসে দেখি ওরা নেই। মোবাইলে ফোন দিলাম কিন্তু বন্ধ। সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাচ্ছিলাম না। পরে মনে হলো- সহস্রধারা ঝরনা এই পথেই, ওরা হয়তো ওইখানে যেতে পারে। তাই আমরাও এগিয়ে চললাম।
পথে অনেক পর্যটকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কেউ সিএনজি করে, কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। কিছুদূর যেতেই দেখলাম সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। তখন মনে হলো- রথও দেখা হল, আবার কলাও বেচা হলো। দেখছিলাম সমুদ্রের বিশালতা। কিছুক্ষণ পরেই মনে হল- আজ অনেক দূর যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম।
সামনে কিছুক্ষণ যেতেই বসার জন্য পাকা বেঞ্চ, সেখানে একটু বিশ্রাম নিলাম আর ব্যাগে থাকা বিস্কুট, কিসমিস আর পানি খেলাম। বাম পাশে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, যেখানে ৬শ’র মতো সিঁড়ি রয়েছে, এই ৬শ’ সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামলেই সহস্রধারা ঝরনা। ধীরে ধীরে আগাতে থাকলাম কিন্তু সিঁড়ি তো আর শেষ হয় না।
একটা সময় এসে পড়লাম সেই কাঙ্ক্ষিত সহস্রধারায়। খুব চমৎকার একটা ঝরনা। সরু হয়ে নেমে যাওয়া পানি পড়ছে এক বিশাল কুমে। পর্যটকরা হৈ-হল্লা করছে। মনকে শান্ত করার জায়গা-ই মনে হয় এই সহস্রধারা ঝরনা। পথ অনেক বাকি তাই এখানেও গোসল না করে ফিরতে শুরু করলাম। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সেই ৬শ’ সিঁড়ি পার করলাম।
Advertisement
এবার তো শরীর আর পেরে উঠছে না। তাই সিএনজি নিয়ে চলে আসলাম গেটের সামনে। গেটের সামনে থাকা আখ দেখে জিহ্বার পানি পরে পরে অবস্থা। ফলে নিয়ে নিলাম আখ আর খেতে খেতে হাঁটতে শুরু করলাম। মেইন রোডে এসে লেগুনাতে করে মিরসরাই চলে আসলাম।
মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তরপার্শ্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে খৈয়াছড়া ঝরনার অবস্থান। এরমধ্যে ১ কিলোমিটার পথ গাড়িতে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হয় পায়ে হেঁটে। প্রথম এই ১ কিলোমিটার অটো দিয়ে গেলাম ১০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে। তারপর হাঁটা শুরু। রাস্তায় প্রচুর কাদা ছিল। কারণ কিছুক্ষণ আগেই ভারি বৃষ্টি হয়েছিল। এর মাঝখানে কয়েকজন আছাড় খেয়ে পড়েছিল। একটা বাঁশের ছোট্ট সাঁকো আছে। তার পাশেই একটি হোটেল। সবাই খৈয়াছড়া ঝরনায় যাওয়ার আগে এই হোটেলে খাবারের অর্ডার করে যায়। দাম খুব একটা বেশি নয়। এখানেই অতিরিক্ত জিনিসপত্র রেখে শুধু মোবাইল, হাল্কা খাবার আর ফার্স্টএইডের জিনিসপত্র ছোট্ট ব্যাগে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এর মধ্যেই রুবেল আর অর্জুন গাইড ঠিক করে ফেলেছিল। গাইড আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি করে লাঠি ব্যবস্থা করে দিল।
এরমধ্যেই দলবেঁধে (বাপ্পি, জুয়েল, অর্জুন, আলমগীর, আলম) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মসজিদের টয়লেটে চলে গেল। ওরা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা শুরু করলাম। শুরুতেই ঝিরি পথ ছিল। কিছুক্ষণ পরে আবার সমতলের রাস্তা। সামনে যতোই এগোচ্ছি মানুষের আধিক্য ততোই লক্ষ্য করছি। ছোট, মাঝারি, বয়স্ক, মহিলা- এমনকী বাচ্চা কোলে নিয়েও মহিলারা সেই খৈয়াছড়া ঝরনা দেখে ফিরছে। তাদের দেখে আমাদের মনে ঝরনা দেখার ইচ্ছা ততোই প্রবল হয়ে উঠছে। জাকির কয়েকবার পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। ব্যথা তেমন পায়নি। তাই আবার হাঁটা শুরু। কক্সবাজারের পর এখানেই আমি সবচেয়ে বেশি পর্যটক দেখেছি। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের মতো হেঁটে চলে আসলাম চোখজুড়ানো খৈয়াছড়া ঝরনায়। যখনই আমরা ছবি তুলছিলাম; তখনই দেখলাম অনেক মানুষ ঝরনার বাম পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠছে। আমরাও সাহস নিয়ে শুরু করলাম উপরের দিকে ওঠা।
প্রথমেই ভাবছিলাম, কী আর এমন কষ্ট হবে? রাঙ্গামাটির সুবলংয়ের উপরেও উঠেছিলাম, তারচেয়ে বেশি কষ্ট হবে না হয়তো। কিছুক্ষণ পরে প্রথম ধাপটি পেরোতেই আমার সেই ভুল ভাঙল। দ্বিতীয় থেকে যখন তৃতীয় ধাপে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের দলনেতা রুবেল গাছের শিকড় বেয়ে উপরে ওঠার সময় শিকড় ছিড়ে পড়ে যাচ্ছিল। ভাগ্য ভালো ছিল বলে একটা দড়ি পেয়েছিল আর সেটি ধরেই বেঁচে গিয়েছিল। আর জাকির তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, এই তৃতীয় ধাপটি অতিক্রম করতেই। এরমধ্যে মামুন আর অর্জুনের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল- কে তাদের মধ্যে আগে সবগুলো ধাপ শেষ করবে। যদিও এই যাত্রায় মামুনই জিতে যায়। একটার পর একটা ধাপ শেষ করছি আর নেশা আরো বেড়েই চলছে সবগুলো ধাপ শেষ করার। এমনি করে করে আমরা ১১টা ধাপ শেষ করলাম। অনেক ছবিও তুললাম।
মনে হয়, বাংলাদেশের মধ্যে এই ঝরনাটাই সবচেয়ে আলাদা। অন্যকোন ঝরনার এটার মতো ১১টা ধাপ নেই। এরপর সেই কিসমিস, খেজুর, বিস্কুট খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবারো ফেরার পালা। কিন্তু নামতেই ইচ্ছা করছিল না। মনে হচ্ছিল এখানেই থেকে যাই। কিন্তু ফিরতে যে হবেই। পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামতেই বেশি সতর্কতা ও কষ্ট হয়।
ধীরে ধীরে একসময় নিচে চলে আসলাম। আবার সেই ঝিরি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের অর্ডার করা হোটেলে চলে আসলাম। মনে হচ্ছিল- কী অমৃত খাবারটাই না খাচ্ছি। খাবার খেয়ে সিএনজি করে ফিরলাম মেইন রোডে। সেখান থেকে লেগুনা করে অলংকার মোড়। এভাবেই শেষ হয়েছিল দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ।
চলবে-
এসইউ/পিআর