ময়মনসিংহ বিভাগের প্রশাসনিক ও নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চরাঞ্চলের জমি অধিগ্রহণে ‘বিকল্প’ প্রস্তাব দিয়েছে বসতভিটা রক্ষা আন্দোলন কমিটি। তারা বলেছে, সরকারের পরিকল্পনায় যে জমি অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে তাতে ২০ হাজার পরিবারের ৬০ হাজার মানুষের বসতভিটা উচ্ছেদ হবে। এতে অনেকে বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারাবেন। বসতভিটা রক্ষা কমিটির প্রস্তাব হলো- ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট মহাসড়কের চায়নামোড় ও দুলালবাড়ি চরে পাঁচ হাজার একর খাস জমি আছে। সেখানে অধিগ্রহণ করা হলে বসতভিটা ও ফসলি জমি রক্ষা পাবে। রোববার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘৬০ হাজার মানুষের অস্তিত্ব বিলীন করে বিভাগীয় শহর : ময়মনসিংহ নতুন বিভাগ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এ প্রস্তাব দেয়া হয়। নিরাপদ ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানার সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন লেখক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, ময়মনসিংহ-৮ আসনের সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম, ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ফয়েজুর রহমান ফকির, সাবেক সচিব তপন কুমার সরকার, বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ মোশাররফ হোসেন বাচ্চু, উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আমিনুর রসুল বাবুল, বসতভিটা রক্ষা কমিটির সমন্বয়ক শহিদুল ইসলাম, আইনজীবী শফিকুল ইসলাম, স্থানীয় বাসিন্দা কাজী রফিক প্রমুখ। মতবিনিময় সভায় বক্তারা বসতভিটা রক্ষা করে চারটি ইউনিয়নে (চরনিলক্ষীয়া, চরঈশ্বদিয়া, চরসিরতা ও খাগডহর ইউনিয়ন) সমহারে জমি অধিগ্রহণের দাবি জানান।মতবিনিময় সভায় সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ময়মনসিংহ বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য যে স্থান অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে ৬০ হাজার মানুষ বসবাস করে। সেখানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ফসলি জমি রয়েছে। এমন একটি এলাকায় বিভাগের অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ খামখেয়ালি, আমলাতান্ত্রিক কারসাজি ও চক্রান্ত। এ কাজটি যারা করেছেন, তারা খামখেয়ালি করেছেন। বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তদন্ত করবেন, তিনি পুর্নবিবেচনা করবেন। কারণ এর সঙ্গে ৬০ হাজার মানুষের আবেগ-অনুভূতি জড়িত। সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘বিভাগ ঘোষণার পর ময়মনসিংহের মানুষ উৎফুল্ল ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিভাগের জন্য সুন্দরভাবে নকশা করতে। এরপর ময়মনসিংহে ১৭ জন সচিবের উপস্থিতে বৈঠক হয়। সে বৈঠকে ১২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব করা হয়। সে প্রস্তাবনায় কোনো বসতভিটা ছিল না, ছিল না ফসলি জমিও। কিন্তু হঠাৎ সেই পরিকল্পনা বদলে ৪ হাজার ৩৬৬ একর জমির নকশা করা হয়। যেখানে ৬০ হাজার মানুষের বসতি রয়েছে। এ নকশায় শুধু একটি সার্কিট হাউজের জন্য ৬০ একর জমির বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এমন একটি সিদ্ধান্ত কীভাবে হলো তা আমিও জানি না।’ তিনি বসতভিটা রক্ষা কমিটির বিকল্প প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আশা করি সরকার এ প্রস্তাবটি বিবেচনা করবে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচ হাজার একর জমিতে অবকাঠানো নির্মাণ করলে বসতভিটা ও ফসলি জমি রক্ষা পাবে। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের সব উন্নয়ন জনগণের জন্য। অথচ জনগণকে অসন্তুষ্ট করে উন্নয়ন করা যাবে না। জনগণের স্বার্থ আগে দেখতে হবে। জমি অধিগ্রহণের পূর্বে গণশুনানির আয়োজন করা দরকার। ৬০ হাজার মানুষকে হঠাৎ উচ্ছেদ করলে তারা যাবে কোথায়? ’ সাবেক সচিব তপন কুমার সরকার বলেন, ‘এলাকার মানুষকে সম্পৃক্ত না করে এমন নকশা করা হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবীদরা বাস্তবে সেখানে যাননি। মনগড়াভাবে নকশা করা হয়েছে। চর এলাকার এক হাজার ৫০০ একর খাস জমি বাদ দিয়ে নকশা করা হয়েছে।’ বসতভিটা রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে মতবিনিময় সভায় বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়ের তিনটি ইউনিয়নের চার হাজার ৩৩৬ একর ভূমি নিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরের অবকাঠানো নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। যা বাস্তবায়িত হলে ৬০ হাজার মানুষ, ২৮ হাজার বাড়িঘর, ৪৭৫টি পারিবারিক কবরস্থান, ৩০টি সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি হাইস্কুল, ছয়টি ঈদগাহ মাঠ, পাঁচটি বাজার, ৪৭টি মসজিদ, ২৫টি মাদরাসা, চারটি মন্দির, দুটি মাজারসহ বৃক্ষরাজি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।এতে আরও জানানো হয়, গত ৯ থেকে ১০ মাস ধরে প্রশাসনের নির্দেশে এই তিনটি ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে জমি বেচা-কেনা ও নতুন বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সাদি হচ্ছে না। উচ্ছেদের ভয়ে একাধিক বিয়ে ভেঙে গেছে। তারা এখন নিরূপায় হয়ে পড়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রথমে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে এক হাজার ২২০ একর জমিতে নতুন শহর গড়ার নকশা প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে ওই নকশা বাতিল করে নতুন নকশা অনুযায়ী চার হাজার ৩৬৬ একর ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর থেকেই বসতভিটা রক্ষার দাবিতে চরাঞ্চলবাসী গত চার মাস ধরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশসহ লাগাতার কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এমএসএস/জেডএ
Advertisement