ফিচার

আমার মা আমার পৃথিবী

আমি যেখানে জন্মেছি সে ভূমিটুকুকে অজোপাড়াগাঁ বলা চলে না। আবার বলা যায় না মফস্বল কোনো শহরও। বর্তমানে সে গ্রামটিতে আধুনিক জীবন যাত্রার ছোঁয়া লেগেছে, কাঁচা রাস্তার বদলে পাকা রাস্তা এসেছে, ঘরে ঘরে সাদাকালো টিভির পরিবর্তে স্থান পেয়েছে ল্যাপটপ, রঙিন টেলিভিশন। এ সবকিছুই বদলে দিয়েছে সময়ের স্রোত। আমি যতটুকু না শহরে থাকি ততটুকু সময়ই আমার মন আনচান করে গ্রামের জন্য। মা সেই গ্রামে থাকেন। আমি থাকি তাঁর নাগালের বাইরে।

Advertisement

গ্রাম আর মায়ের মধ্যে যে বেশ মিল, তা আমি একটু ভাবতে বসলেই বুঝে যাই। তারা যেন জোড়মানিক। আমার গ্রামটির মতো মা-ও আত্মভোলা, সন্তানের চিন্তায় চিন্তিত, সহজ-সরল। ছেলেবেলার কথা ভাবলে অবাক লাগে- বিস্মিত হই। কত জ্বালাতন করেছি তাঁকে। তাঁর সহ্যসীমা আমার জানা নেই। পাঁচ পাঁচটি ছেলেমেয়ের ভার তাঁর ওপর।

কৈশোরে দেখতাম, সকাল হতেই মা ঘরকন্নায় লেগে যেতেন। উঠোন ঝাড়ু দেওয়া, থালা-বাসন ধোয়া— তারও আগে ফজরের নামাজ পড়া এসব তাঁর নিত্য রুটিন। নাস্তা বানাতে বানাতে মা আমাদের ভাই-বোনদের পড়াতেন। দেখতাম মায়ের নাকেমুখে চুলার কালি, কালো চুলে ছাইয়ের কুয়াশা। তাঁর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ কখনো ছিলো না। নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ পড়ার পর আমাদের স্কুল যাত্রার পালা। ছোট ভাই-বোন দু’টো তখনো ছোট। আমরা তিনজন যেতাম স্কুলে। স্কুলের পড়া তিন ভাই-বোন চকিতে বসে পড়তাম। রসুই ঘর থেকে মা তাগাদা দিতেন যেনো জোরে জোরে পড়ি। আমরা যখন পাল্লা দিয়ে জোরে জোরে পড়তাম, মা তখন চুলায় লাকড়ি গুঁজতেন, কানকে আরো সজাগ রেখে আমাদের পড়া শুনতেন, ভুল হলে শুধরে দিতেন।

স্কুলের সময় হবার আগেই মা’র রান্নাবান্না শেষ হতো। আমাদের হাতমুখ ধুইয়ে ভাত খেতে বসাতেন। মায়ের হাতে খাওয়া। এ কথা- সে কথা বলে তিনি ভাত মুখে তুলে দিতেন। আমি তখন নিজের হাতেই খাই। ভাই বোনদের তখনো মায়েরই খাইয়ে দেওয়া লাগতো। আমরা যখন ভরপেটে স্কুলের পথের যাত্রী, হাতে বই কলম— জানতাম মা তখন সবে একটু অবসরে সকালের নাস্তাটুকু নয়তো গতকালকের বেঁচে যাওয়া তরকারি দিয়ে ঠান্ডা ভাত খেতে বসবেন।

Advertisement

স্কুল থেকে টিফিনে বাড়ি আসলে মা আমাদের গোসল করাতেন, সকালের মতো ভাত বেড়ে পিড়িতে বসে খাইয়ে দিতেন। স্কুলের ছুটির শেষে না হয় আমাদের দুষ্টুমিতে একটু দেরি হতো বাড়ি ফিরতে— কিন্তু জানতামই না এ বিলম্বে ফেরা সময়টুকু মা’র কাছে ছিলো কতো চিন্তার, অস্থির চিত্তের। আমরা আসছি না দেখে প্রায় দিনই মা স্কুলের পথে এগিয়ে আসতেন। একান্ত বাধ্য স্কুলছাত্রীর মতো মা-ও আমাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতেন। বিকেলে ছোট ভাই-বোন জোড়া মার সাথে সাথেই থাকতো, আমরা বেরিয়ে পড়তাম খেলার সন্ধানে। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের সাথে মাছ-মাছ, চোর-পুলিশ, সাতচাড়া খেলা আমাদের নিত্য রুটিন। কখনো কখনো মা দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখতেন। আমরা কেউ কোথায়ও পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই বাজপাখির মতো ছুটে আসতেন— আমাদের কান্নায়, খানিক উল্টে যাওয়া নখ দেখে মা’র হৃদয়ে কতটুকু রক্তক্ষরণ হতো তখন হয়তো বুঝতে পারিনি।

বৃষ্টির দিন ছিলো আমাদের জন্য আনন্দের। স্কুল যাওয়া হতো না। তাই প্রায়ই মনে মনে প্রার্থনা করতাম— যেনো বৃষ্টি নামে অঝোর বর্ষণে! দিন অন্ধকার করে ঝরুক শ্রাবণের জলধারা— সারাদিন ঝরুক তবে। এও ছিলো উৎসবতুল্য। মা এমন দিনে বলতেন— ‘কি খাবি তোরা?’ মা বৃষ্টিতে ভিজে এক দৌড়ে রসুই ঘরে যেতেন। চাল ভাজতেন, সয়াবিন ভাজতেন— মাঝেমধ্যে বানাতেন ঝাল পিঠা, কাঁঠালের হালি, শিমের বিচি ভাজা ছিলো মা’র অনেক প্রিয়। কুপি নিভিয়ে আধা অন্ধকারে মা আর আমরা চাল-সয়াবিন ভাজা খেতাম— সাথে সাথে মা গল্পও বলতেন। রূপকথার গল্পের তোড়ে এসে যেতো জীবনের গল্পও। মা বলতেন আমার দাদা-দাদির কথা। নানা-নানুর কথা। বাবার কথা। এমন বৃষ্টিঝরা দিনে মা তার স্মৃতি আওড়াতেন। বলতেন, ‘আমার স্কুলের পাশেই বসতো এক বাদামওয়ালা। তিনি লাভের বাদামগুলো নিজে আগেই খেয়ে ফেলতেন। একজন বুড়ো বিক্রি করতো কদমা, বাতাসি আরো অনেক হাবিজাবি। আব্বা-আম্মা টাকা দিলেই কদমা কিনতাম। বাতাসা কিনতাম। ...সোলাইমান চাচা কানে শুনতো কম। যখন বলতাম, চাচা বাবুল বিস্কুট দেন। চাচা বলতো, শনপাপড়ি চারটা এক টাকা। আমার বান্ধবীরা তো দুষ্টু কম না। বলতো, চাচা ওইটা দেন তো। চাচা পেছন ফিরে যখন কিছু দিতো, এই সুযোগে তাসলিমা, মরিয়মরা কিছু বাবুল বিস্কুট, সন্দেশের প্যাকেট চুরি করে ফেলতো।’

মা তাঁর স্কুল জীবনের গল্প বলতেন, হাসতেন। মাকে তখন মনে হতো ক্লাস টেনে পড়ুয়া কিশোরী। আমরা তাই বৃষ্টি এলেই মায়ের পুরনো দিনের গল্প শুনতে চাইতাম। মা-ও বলতো সোৎসাহে। এ গল্প কখনো ফুরাতে দেখিনি। শামসুর রাহমান কবিতায় বলেছিলেন— ‘আমি আমার মাকে কখনো গান গাইতে দেখিনি।’ কবিতাটা পড়েছিলাম কলেজ জীবনে। শৈশবে পড়া হয়নি। কবিতাটি পড়ে সেদিন মনে হয়েছিলো— সত্যি! এতো শামসুর রাহমানের কথা নয়। এতো আমার মায়েরই কথা— যাকে আমি কখনো গান গাইতে দেখিনি। অথচ মা নাকি স্কুল জীবনে গান গেয়ে কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাবার অভাবটা জীবনে কমই বোধ করেছি। মা-ই সবটা পূরণ করেছেন। বাবার মৃত্যুটা মনে আছে শুধু তা-ও আবার ধূসর সব স্মৃতি। সেই স্মৃতিতে ময়লা জমেছে। কখনো বাড়ি গেলে মাকে প্রায়ই বলতে ইচ্ছে করে— ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা...’ গানটা একটু গাইবে? কিন্তু বলা হয় না। সেই কিশোরী গানপাগল বয়স কি মায়ের আছে? মায়ের বয়স তো এখন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই।

শহুরে জীবনে আমি যখন ক্লান্ত, বিমর্ষ— একটু চোখ বুঁজে শান্তির সন্ধানে ফিরি, দেখি চোখের সামনে ভেসে উঠছে মায়ের ছবি। আমার সাদামাটা মা। সহজ-সরল মুখ। সে মুখে কত ইতিহাসের বলিরেখা। পরনে সবুজ ছাপার শাড়ি। মার কাঁখে কলসি। পানি আনছেন। কখনো দেখি শিম ফুল দেখে মা হাসছেন। ঠিকঠাক করে দিচ্ছেন লাউয়ের মাচা। শান্তির সন্ধান পেতে তাই আমার দেরি হয় না। মা— কী শান্তি, কী অসম্ভব মধুময় বুলি। আমি যখনই গ্রামের পথে ছুটি, মাকে না জানিয়েই যাই বাড়িতে। খুব ভোরে। কাকডাকা প্রাতের মধুরতায় যখন পৌঁছে যাই ঘরের দরজায়। মা হয়তো ঘর ঝাট দিচ্ছেন। আমাকে দেখে প্রথমে হয়তো মার মনে হয়— এ তাঁর চোখের ভ্রম। কিন্তু যখন বলি, ‘ভালো আছো মা?’ মা চমকে ওঠেন। তাঁর পবিত্র হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অন্দর-বাহির। তাঁর অবাক হওয়া মুখখানি আমি বারবার দেখি। এমন মুহূর্তে মা বলেন, ‘আমাক ফোনে বলিসনি কেন তুই আসবি?’ আমি শুধু হাসি। আমাকে কিছু খেতে দিয়ে মা পাশে বসে থাকেন। পাশে তাঁর পানের বাটা। পান খেতে খেতে বলেন, গ্রামের কথা, বাড়ির কথা। কে কেমন আছে, এসব কথা। বারবার জিজ্ঞেস করেন, কেন শুকিয়ে গেছি আমি!

Advertisement

বাড়ি গেলে মা কতো কী রাঁধেন! পিঠা বানান। চালতার ভর্তা বানান। তাঁর আয়োজনের শেষ হয় না। যেদিন ফেরার দিন, ব্যাগ গুছিয়ে রিকশায় উঠি, রিকশা চলছে... পেছনে তাকিয়ে দেখবো- মা পেছনে পেছনে আসছেন। কত করুণ মুখখানি তাঁর। আমার বুকটা তখন ফেটে যায়, চোখজুড়ে আসতে চায় বন্যার স্রোত। বিষণ্ন ধ্যানে তখন ফিরি ব্যস্ত শহরে তখনো মনে রাখি, আমার মা দাঁড়িয়ে আছেন দূরে এক নিরীহ গ্রামে— জানি, সেই মাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি। কিন্তু অন্যসব কথার মতো এ কথাটিও তাঁকে বলা হয়নি কখনো...

লেখক : কবি ও সম্পাদক, মৃত্তিকা

এসইউ/এমএস