সকাল আটটা। অফিসে এসেই কাজের প্রয়োজনে ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ফেসবুকের ওয়াল ছেয়ে গেছে মা দিবসের শুভেচ্ছায়। মায়ের ছবি, আবেগঘন স্ট্যাটাস আর বিভিন্ন ভিডিও দেখে আবেগপ্রবণ আমিও হেডফোনে আবেগঘন কিছু গান শুনলাম। কাজ হলো না। মানুষটাকে মিস করার পরিমাণটা আরো বেড়ে গেল। নিজেকে অসম্পূর্ণ লাগতে শুরু হলো।
Advertisement
কিন্তু ঠিক করলাম মা যেহেতু ফেসবুক ব্যবহার করেন না, তাই তাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়াটা কেবল শো-অফ। তবে নিজের ফেসবুকের ওয়াল থেকে চুপিচুপি মায়ের কিছু ছবি দেখলাম। মনটা আরো শূন্যতার হাহাকারে ভরে উঠছে। গলাটা ধরে আসছে। কাজ যে করবো, চোখের পানিতে কম্পিউটারের স্ক্রিনটা ঝাপসা দেখতে থাকলাম।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে আছি। কয়েক মিনিট এভাবেই কাটলো...
কিন্তু এ কয়েক মিনিটে যেন জীবন রি ওয়াইন্ড হতে শুরু করলো। যতদূর মনে পড়ে, মা খুব কম সময়ই আমাকে আমার নাম ধরে ডাকেন। ডাকেন ‘মেলে (মেয়ে)’ বলে। যদিও বাড়ির সবথেকে ছোট মেয়ে হওয়ায় নাম ধরে সবাই খুব কম ডাকে। রীতিমত আমার আদরের ডাকের তালিকা করা যাবে।
Advertisement
যাই হোক, ফিরে আসি মা’তে। চোখ বুজেই যেন শুনতে পেলাম রান্নাঘর থেকে শব্দ ভেসে আসছে, ‘এ মেলে কী করছিস ঘরে?’ কানের মধ্যে বাজতে থাকলো, ‘মেলে এটা খাবি, ওটা খাবি’? বন্ধ চোখে আবছা অন্ধকারে ভাসতে থাকলো সারাদিনে মা’র ছোটাছুটি। ব্যস্ত মা আমার।
আমরা ছয় ভাই-বোন। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। ব্যাস। আমাদের মা একা আমাদের মানুষ করেছেন। তার যে কত কষ্ট হয়েছে তা দু’জনের সংসারেই গত দশ মাসে বুঝে গেছি। আরো বেশি করে বুঝি- বোনেরা তাদের বাচ্চাদের শাসন করলে মা যখন রাগ হয়ে বলে, ‘একটা পালতে গিয়েই এই করছিস? আমি তো ছয়টা মানুষ করলাম।’ আসলেই আমাদের মা আমাদের কখনও মারধর করেননি। দুষ্টুমি যে করিনি; তা নয়। আমার মা শাসন করেছেন কিন্তু মারেননি। মনে পড়ে- যখন ভাইয়ার সঙ্গে মারামারি করতাম; তখন মা থামাতে না পারলে যেকোনো একজনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতেন।
উহ্! বুকের ভেতর একটা মোচড়ানো কষ্ট সাড়া দিল। অনেকদিন মার বুকের মধ্যে যাইনি। তখন; যখন মা বুকের মধ্যে নিতেন- রাগ হতো। মা না ধরলে ভাইয়াকে আরও কয়েকটা মার দিতে পারতাম। বুঝতে পারিনি সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি একটিবার মা আবার সেভাবে বুকে নিতেন... কোনো জড়তা থাকতো না। সত্যি বলছি- পুরোটা অনুভব করতাম।
চোখে কখন জানি পানি এসে গেছে। গড়িয়ে পড়তেই ভাবনার ইতি ঘটলো। অফিসে আছি। কাজ করতে হবে। কাজে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু পারলাম না। নিজের ওয়ালে ‘আম্মা’ লিখে রাখলাম। ভাবলাম কাজ হবে। কিন্তু হলো না।
Advertisement
বুকের ভেতর ব্যথাটা বাড়ছেই। খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে- একবার যদি মাকে কাছে পেতাম, শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম। অনেকক্ষণ মাকে জড়িয়ে ধরে রাখতাম। বলে দিতাম, তাকে কতোটা ভালোবাসি।
নাহ্। আর পারছি না। আজ মাকে বলবো, তাকে ভালোবাসার কথাটা। বড় হওয়ার পর সে যে আর আমাকে কোলের মধ্যে নেয়নি; সেই অভিযোগের কথাটা। তার গন্ধ যে আমি ভুলতে বসেছি; সেই কষ্টের কথাটা। আমার তাকে দেওয়া কষ্টগুলো যে আমাকেই কুড়ে কুড়ে খায়; সেই কথাটা। আজ সব বলবো মাকে। আজ বলেই দেবো।
ফোন দিলাম বাসার ফোনে। ভেবেছিলাম আব্বু ধরবে। যাক মা-ই ধরলো। এপাশ থেকে ‘হ্যালো আম্মা’ বলতেই মা বলে উঠলেন, ‘কে মেলে? কাল ফোন করোনি কেন? আমি জানি অনেক ব্যস্ত ছিলে? অফিসে যাওনি? অফিস থেকে ফোন করেছ কেন?’
এপাশ থেকে শুধু বলে উঠলাম, ‘আম্মা, শুনেন না...’
সে কিছুটা বিরতি দিয়ে বলতে থাকলো, ‘আমি কেবল রান্নাঘরে গেলাম। তোমার আব্বু আবার কী বলছে? রান্নাঘরে মুরগি ঢুকেছে? তোমার আব্বু খেয়ে বাজারে যাবে। তুমি সকালে কিছু খেয়েছো? হ্যাঁ, মেলে ফোন দিয়েছে কথা বলছি। তো এখন রাখি নাস্তা বানাতে হবে। আচ্ছা, তুমি কিছু বলবা? রাতে ফোন দিও।’
শেষমেষ রাগ করে বললাম, ‘আচ্ছা মা রাখি। পরে কথা বলবো।’
লেখক : সহ-সম্পাদক, জাগোনিউজ২৪.কম
এফএ/এসইউ/পিআর