আমার ধারণা, আমার মায়ের অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে!ফুটবল খেলতে যাব। পায়ে পরার ছোট্ট এইটুক এক অ্যাংকলেট। সারাঘর খুঁজে তন্নতন্ন করি। নেই! আম্মা কাজে ব্যস্ত। আমার চিৎকার, ‘আম্মা, ও আম্মা, অ্যাংকলেটটা কই?’- দ্যাখ, ওইহানেই আছে।- কোনখানে আছে? - ঘরেই আছে। আল্লায় চোউখ দিছে ক্যান? চোউখ দুইখান মেইল্যা দেখ।- সারাঘর তন্নতন্ন কইর্যা খুঁজলাম, পাই না। ও আম্মা, আম্মাআ! আম্মাআআআ!আম্মা ঘরে আসলেন। তারপর কি করলেন কে জানে, অ্যাংকলেটখানা ভোজবাজির মতন তার হাতে! তিনি সেটা আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘নিজের জিনিস নিজেই জানোস না, কই রাখোস! আর কাজের সময় খালি আম্মা আম্মা...!’
Advertisement
আমি হতভম্ব হয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘ইজ শি অ্যা ম্যাজিশিয়ান?’
দুই.ভাত খেতে বসেছি। ডিম ভাজি আর ডাল। সমস্যা হচ্ছে ডিম একটা। কিন্তু আমরা দুই ভাইই আস্ত একটা ডিম ছাড়া ভাত খাবো না। এ নিয়ে তুমুল ঝগড়া- একেবারে কুরুক্ষেত্র! আম্মা নানান কিছু বোঝালেন, কিন্তু কাজ হল না! যুদ্ধ বরং বাড়ল। আম্মা গজগজ করতে করতে ডিম নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু ফিরলেন দু’খানা আস্ত ভাজা ডিম নিয়ে!
Advertisement
তারপর পাতে তুলে দিতে দিতে গর্জে উঠলেন, ‘তোরা দুইডা, তোরা দুইডা আমার হাড় জ্বালাই খাবি। এই সংসার ছাইড়্যা আমি যাইমু গিয়া! আর পারি না, আমি আর পারমু না! দেখমু তোগো কোন মায় আইস্যা প্রত্যেক বেলায় কোর্মা-পোলাউ রাইন্ধা খাওয়ায়...’
আমি হতভম্ব হয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘ইজ শি অ্যা ম্যাজিশিয়ান?’
তিন.ঈদে আব্বা দুই ভাইয়ের জন্য জামা এনেছেন। সেই জামা হয়েছে ছোট। দুইভাই তারস্বরে চিৎকার! খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। মাটিতে গড়াগড়ি। আম্মা বারকয়েক বোঝালেন, ‘একটু ছোট হইলে কিছু হয় না।’কিন্তু আমাদের চিৎকার বাড়ে। আমরা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে কাঁদি। কেঁদে ঘুমাই।
আমাদের ভয়াবহ অভাবের সংসার। সেই সংসারে আর কোন নতুন জামার সুযোগ নেই, সে আমরা জানি। জানি বলেই কষ্ট তীব্র হয়। সুতীব্র কষ্ট! আমরা জগতের ভয়াবহতম অসহায়ত্ব নিয়ে কষ্টে ডুবে থাকি। ঈদের আগের রাতে আম্মা হঠাৎ ঘুম থেকে টেনে তোলেন, তার হাতে জামা! নতুন জামা!!
Advertisement
আমরা চোখ কচলে তাকাই। বা হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলি, তারপর লাল গোলগোল চোখে হতভম্ব হয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘ইজ শি অ্যা ম্যাজিশিয়ান?’
চার.বড় হয়ে জেনেছি জগতে ম্যাজিক বলতে কিছু নেই। যা আছে তার নাম কৌশল। তার নাম ট্রিকস! চোখে ধুলো দেওয়া। তাহলে? তাহলে, আম্মা কি আমাদের চোখে ধুলো দিতেন? হ্যাঁ, দিতেন।
একটা ডিমের ভেতর কুমড়ো ফুল বেঁটে দিলে কি করে দুটো ডিম বানানো যায়, সেই ট্রিকস তিনি জানতেন। সেই চোখে ধুলো দেওয়াটা জানতেন। মায়েদের জানতে হয়। জানতে হয়, চোখের পলকে কি করে সব খুঁজে পেতে হয়। জানতে হয়, ঈদে পাওয়া নিজের একমাত্র শাড়িখানা কেটে দু’ভাগ করে দু’টো শার্ট কী করে বানাতে হয়! এমন অজস্র ট্রিকস মায়েদের জানতে হয়। কারণ ‘দে আর দ্য ম্যাজিশিয়ানস! দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি ম্যাজিশিয়ানস অন আর্থ!’
পাঁচ.ঢাকার জীবন। প্রবল জ্বর। জগতসংসার বিস্বাদ। রাজ্যের ওষুধ, ডাক্তার, বন্ধু, প্রিয়জন, নানান ট্রিটমেন্ট। ঠিক সেই মুহূর্তে, মাঝরাতে হঠাৎ বুকের ভেতর তীব্র হাহাকার, ‘মা, মাগো, ও মা, মাগো...’নাকের ভেতর হঠাৎ ঘ্রাণের তীব্র তেষ্টা, ‘ও মা, মাগো... মা, মা, মায়ের আঁচল। আঁচলের ঘ্রাণ।’ কপালের ওপর তখন স্পর্শের তেষ্টা। তীব্র তেষ্টা, ‘ও মা, মাগো, ও মা, মা, মাগো...’
মায়েরা জাদু জানেন। একটু আঁচলের ঘ্রাণ, একটু কপালে স্পর্শ! সেই স্পর্শের ক্ষমতা দেখে হয়তো ওষুধ-পথ্যরাও হতভম্ব হয়ে যায়। হয়তো তারাও ভাবে, ‘ইজ শি অ্যা ম্যাজিশিয়ান?’ইয়েজ, শি ইজ। দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি ম্যাজিশিয়ান অন আর্থ, ‘মা, ও মা, মাগো...’
লেখক : তরুণ লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
এসইউ/এমএস