আমদানি ও রফতানির মূল্য হেরফের দেখিয়ে অর্থাৎ আন্ডার-ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার হচ্ছে। ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্যে থেকে ‘বৈধ’ পথে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ আমদানি-রফতানি হচ্ছে, এর মোট লেনেদেনের মূল্য প্রদর্শনে সূক্ষ্ম কারসাজি হচ্ছে। দেশে মোট বাণিজ্যের সর্বনিম্ন ৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বাইরে পাচার হচ্ছে। এ হিসাবে গত ১০ বছরে বৈধ পথেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জিএফআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১০ বছরে (২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল সময় পর্যন্ত) বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়েছে ৪৪ হাজার ৬১৫ কোটি ডলার। দেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ঋণপত্র খুলে (এলসি) ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এ অর্থ লেনদেন হয়েছে।
লেনেদেনের ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যের কারসাজির মাধ্যমে মোট বাণিজ্যের সর্বনিম্ন ৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাইরে অর্থ পাচার হয়ে গেছে। তবে অন্যদেশ থেকেও অবৈধভাবে মোটি বাণিজ্যের সর্বনিম্ন চার থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত পাচার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
Advertisement
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কারসাজি করে মূল্য বাড়িয়ে অর্থপাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সর্বনিম্ন এক শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ চার শতাংশ পর্যন্ত পাচার হয়েছে। এ হিসেবে গত দশ বছরে আমদানির আড়ালে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা (৪৪৬ কোটি ডলার) এবং সর্বোচ্চ হিসেবে এক লাখ ৪২ হাজার ৭২০ কোটি টাকা (এক হাজার ৭৮৪ কোটি ডলার) পাচার হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা বলেন, জিএফআই প্রতি বছর এ ধরনের প্রতিবেদন করে। যা অনুমান নির্ভর। এজন্য বিষয়টি নিয়ে বথা বলা কঠিন। তবে বাংলাদেশ থেকে কোনো অর্থ যেন পাচার না হয় সে বিষয়ে মানি লন্ডারিং বিভাগ কাজ করছে। এ বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয় আনা হবে। যেন কোনোভাবেই দেশের কোনো অর্থ বিদেশে যেতে না পারে। এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আয় পোশাক শিল্পে। রফতানির ৮২ শতাংশ তারাই করে। পাচার চক্রে তারাই যুক্ত। পোশাক শিল্পে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য শুল্ক নেয়া হয় না। কম দামে মাল কিনে বেশি দাম দেখানো হয়। অতিরিক্ত টাকা ফাঁক গলে চলে যায় বিদেশে।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানি-রফতানির আড়ালেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারিও বেড়েছে যার চিত্র জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে বিদেশে অর্থ পাচার অনেক পুরানো। আগের পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রতি বছরই অর্থ পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা (সাত হাজার সাত কোটি ডলার) আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়েছে। ওই বছরে আমদানি-রফতানির নামে সর্বনিম্ন সাত থেকে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ অর্থ পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে এ পরিমাণ সর্বনিম্ন ৩৯ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ভোগ্যপণ্যের মূল্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকলেও ক্যাপিটাল মেশিনারিজের ক্ষেত্রে সেটি নেই। যাচাইয়ের মাধ্যম না থাকায় আমদানিকারকরা অর্থ পাচারের সুযোগ নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা আমদানি-রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রক কার্যালয় পৃথক একটি সেল গঠন করতে পারে। যারা মূলধনী যন্তপাতির দাম যাচাই করে তা ব্যাংকগুলোর কাছে সরবারহ করবে। তাহলে আমদানির আড়ালের অর্থ পাচার অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।
এমএ/এমএআর/আরআইপি