রাজধানীর বনানীতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নিতে টালবাহানা, সময়ক্ষেপণ ও ধর্ষিত দুই তরুণীকে নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বনানী থানার কর্তব্যে কোনো ‘অবহেলা’আছে কি না তা খুঁজবে এই কমিটি।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিএম ফরমান আলী ফেঁসে যেতে পারেন। দুই তরুণীর মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে ওসির আচরণ ছিল একপেশে। পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বশীল আচরণের বিপরীতে তিনি ভিকটিমদের অসহযোগিতা করেছেন। অন্যদিকে গুলশান বিভাগ পুলিশ বলছে, ব্যক্তির (একজন পুলিশের) দায় বিভাগ বা জোন কখনও নেবে না। কারও দায়িত্বে গাফিলতির প্রমাণ মিললে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গত ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় গত ৬ মে দুই তরুণী বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন।
হোটেলে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর একজন অভিযোগ করে বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আরও কয়েকবার ধর্ষিত হচ্ছি। পুলিশ বারবার একই ঘটনা (ধর্ষণের) শুনতে চাইছিল। অথচ অ্যাটেনটিভলি (মনোযোগ দিয়ে) শুনছিল না। গুরুত্বও দিচ্ছিল না’।
Advertisement
তরুণী বলেন, ‘আমাদের এক কথা বারবার বলতে হচ্ছিল। বারবার ওরা (পুলিশ) ইনফরমেশন মিস করছিলেন। অনেকবার শোনার পর একপর্যায়ে বললেন, এসব কথা লিখতে হবে। আমরা স্টেটমেন্ট লিখলাম। এরপরে বললেন, আপনারা আজ চলে যান, আমরা তদন্ত করব, যদি দেখি ওরা অপরাধী তাহলে আমরা মামলা নেব।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই তরুণী বলেন, ‘পরদিন থানায় ডেকে একই ঘটনা আবারও জিজ্ঞেস করেছে পুলিশ। বলেছে, এটা এটা আপনারা বলেন নাই, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি। তখন আমরা বলছি, আমরা কোনো জিনিস বাদ দেই নাই। আপনারা মিস করেছেন, কারণ আপনারা ইম্পর্টেন্স (গুরুত্ব) দেননি। আবার ডেকে আনছেন একই ঘটনা বলার জন্য।’
থানার অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পরদিন রাতে আমাদের ডাকা হলো মামলার কপি দেয়ার জন্য। যাওয়ার পরে পুলিশ আমাদের আটকে দেন, থানায় থাকতে বলেন। আমাদের বলা হলো, ছবি তুলতে হবে। আমরা তো ব্যাপারটাতে ভয় পাই, ছবি তুলব, আবার কী হয় না হয়। আমরা বলেছি ছবি তুলব না। সেখানে কয়েকজন নারী পুলিশ ছিলেন, তারা আমাদের সঙ্গে রুঢ় হয়ে বলেন, এখনই ছবি তুলতে হবে।’
‘তখন আমরা বিষয়টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মিলি আপুকে জানাই। ‘ভিকটিমদের থানায় থাকতে হবে এমন কোনো রুলস নেই বলে জানান তিনি। পরে অবশ্য আমাদের থানায় না রেখে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’
Advertisement
ওই তরুণী বলেন, ‘আমরা প্রথমে যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন শুরুতে বেশ ভালো ব্যবহার করেছিলেন। আমরা অনেক সাহস পেলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা অন্যরকম আচরণ শুরু করেন। হয়তো অভিযুক্তরা প্রভাবশালী জানার পর থেকে, শুনেছি তারা টাকাও খেয়েছেন অনেক।’
ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়ের ও ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর অভিযোগের পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলা নেয়ার পর দুই তরুণীকে নিয়ে ‘দ্য রেইন ট্রি’হোটেলে যান তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল মতিন। হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দুই তরুণীকে বিদায় দিয়ে সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের বাসায় যান। সেদিন বাসাতেই ছিলেন সাফাত, কিন্তু সেদিন শুধু কথা বলেই বেরিয়ে আসেন তদন্তকারী টিম। এরপর আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ওইদিন তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে কেন পুলিশ ধরবে? আমার ছেলে তো কোনো দোষ করেনি? সেই রাতে যদি কিছু হয়ে থাকে সেটা আপসেও হতে পারে। ধর্ষণ হলে তাহলে নিশ্চয়ই ৪০ দিন মামলা করার অপেক্ষা করত না তারা।’
অন্যদিকে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর মামলা নিতে টালবাহানা, ৪৮ ঘণ্টা দেরিতে মামলা নথিভুক্ত এবং তরুণীদের বারবার থানায় ডেকে হয়রানি করায় দেশজুড়ে শুরু হয় সমালোচনা। আলোচনা-সমালোচনার মুখে গত ৯ মে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পাঁচদিনের ছুটিতে গেছেন বনানী থানার আলোচিত ওসি বিএম ফরমান আলী।
গুলশান বিভাগের (গুলশান জোন) এডিসি আব্দুল আহাদ জানান, ৯ মে থেকে বনানী থানার ওসি বিএম ফরমান আলী পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পাঁচদিনের ছুটিতে গেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশান বিভাগ পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নিজের দায় লুকানোর জন্যই ওসি কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন। পারিবারিক কারণ দেখিয়ে ছুটিতে গেলেও সঠিক তদন্তে ফেঁসে যাবেন ওসি ফরমানই। কারণ মামলার মোটিভ ও গুরুত্ব কিছুই তিনি না জানিয়ে এককভাবে ভূমিকা নিয়েছেন। তার দায় গুলশান পুলিশ নেবে না।
গুলশান বিভাগ পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বনানী থানার কোনো কর্মকর্তার দায়িত্বে গাফিলতির দায় বিভাগ পুলিশ নেবে না। তদন্তের দায়িত্বে গাফিলতি ও ভুক্তভোগী তরুণী দুজনকে হয়রানি করার প্রমাণ মিললে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শুক্রবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, বাদীর আগ্রহে মামলার তদন্তভার উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনসকে দেয়া হয়েছে।
কৃষ্ণ পদ রায় জানান, বনানী থানার কর্তব্যে কোনো অবহেলা আছে কি না সেটি খুঁজতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভিকটিমরা যেসব অভিযোগ করেছেন সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দেবেন।
গঠিত কমিটিতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারকে (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) প্রধান করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি দুজন হলেন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন ও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণ পদ রায়। ভিকটিমরা যেসব অভিযোগ করেছেন সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে কমিটির কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দেবেন।
কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, মামলাটি অতি সংবেদনশীল হওয়ায় তদন্ত কমিটির কাজের সুবিধার্থে আরেকটি সহায়ক তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। কমিটির প্রধান ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণ পদ রায়। এই কমিটিতে আরও আছেন ডিবি উত্তরের উপ-কমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম, গুলশান বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ ও উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনসের ডিসি ফরিদা ইয়াসমিন।
জেইউ/জেডএ/ওআর/পিআর