জাতীয়

কেমন ছিল ‘রেইন ট্রি’ কর্তৃপক্ষের সেদিনের আচরণ?

জন্মদিনের পার্টিতে নিমন্ত্রণ করে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় আলোচিত নাম রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত ‘দ্য রেইন ট্রি হোটেল’। তবে শুরু থেকেই হোটেল কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক আচরণ করছে। পুলিশ ও সাংবাদিকদের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে যাচ্ছে হোটেলটি। পুরো ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও দৃশ্যমান।

Advertisement

জাগো নিউজের কাছে সেদিনের ওই ঘটনায় হোটেল কর্তৃপক্ষের আচরণ কেমন ছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন নির্যাতিত তরুণীরা।

তারা জানান, ‘ধর্ষক’ সাফাত নিয়মিত এ হোটেলের নির্ধারিত একটি কক্ষ ভাড়া নিতেন। সেই রাতেও দুই তরুণী অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন, কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষের কেউই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। এমনকি পরদিন সকালে তাদের হোটেল ত্যাগের পরিস্থিতি নিয়েও হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দেয় বলে দাবি করেন ভুক্তভোগীরা।

নির্যাতিত তরুণীদের একজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা অনেক চিৎকার করেছি, অনেক, অনেক। কিন্তু কেউ আসেনি। এমনকি স্বাভাবিকভাবে একটি হোটেলে তো রুম সার্ভিসের লোকজন আসে। কিন্তু ওই রাতে এমন কেউও সেখানে আসেনি।’

Advertisement

গত ২৮ মার্চ এ হোটেলেই এক বন্ধুর জন্মদিনে যোগ দিতে এসে অপর বন্ধুদের যোগসাজশে ধর্ষণের শিকার হন ওই দুই তরুণী। তাদের ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে রেগনাম গ্রুপের পরিচালক সাদমান সাকিফ, তার বন্ধু আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলে নাঈম আশরাফের বিরুদ্ধে। ঘটনার প্রায় ৪০ দিন পরে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করলে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি হয়।

নির্যাতিত দুই তরুণীর দাবি, পুরো বিষয়টি আগে থেকেই পূর্বপরিকল্পিত। এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল দ্য রেইন ট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষও।

হোটেলটি সিসিটিভি (ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও সেদিনের কোনো ফুটেজ কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি পুলিশকে। ৩০ দিনের বেশি ফুটেজ থাকে না এমন দাবি তাদের।

ভিকটিমদের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন ৭০০ ও ৭০১ নম্বর রুমে ধর্ষণের ওই ঘটনা ঘটে। ওই তরুণীদের একজন বলেন, ‘রাতে শুধু একবার সাফাতের ফ্রেন্ড (বন্ধু) মাহিন এসেছিল। সে এসে আমাদের দেখে চলে যায়। সে নাকি রেইন ট্রি হোটেলের মালিকদের একজনের ছেলে। তখন আমরা বুঝতে পারি, যেহেতু ওই হোটেলটি তার ফ্রেন্ডের বাবার, ঘটনাটি প্রি-প্ল্যানড।’

Advertisement

‘রাত শেষে সবকিছু শেষ করে ওরা (ধর্ষক) আমাদের ওদের সঙ্গে বের হতে বাধ্য করে’- বলেন এক তরুণী।

বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী বলেন, ‘হোটেলের রুম থেকে ৯টার দিকে আমাদের বের করা হয়। যখন আমরা বের হই, তখন আমি হাঁটতে পারছিলাম না। এছাড়া সেই রাত থেকে যে কান্না শুরু করেছি, সকাল পর্যন্ত এক মিনিটও থামতে পারিনি।’

‘যখন চেক আউট করি, তখন টাকা পেমেন্ট করতে বা সাইন করতে তো মিনিট পাঁচেক টাইম লাগে। ওই সময়টা আমি নাইমের পাশে দাঁড়িয়ে ওভাবেই কাঁদতে ছিলাম। এমনকি আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না, আমার ফ্রেন্ড (অপর নির্যাতিতা) আমাকে ধরেছিল।’

তিনি বলেন, ‘সবই ওরা (হোটেল কর্তৃপক্ষ) পাঁচ মিনিট ধরে দেখেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। কিছু জিজ্ঞেসও করেনি, কী হয়েছে। অথচ পুলিশ যখন গেছে, তখন নাকি বলেছে, আমরা সবাই হাসতে হাসতে বের হয়ে গেছি।’

সেদিন জন্মদিনের দাওয়াতে ওই দুই তরুণীর সঙ্গে তাদের একজন ছেলে বন্ধু ও অপর একজন বান্ধবীও গিয়েছিলেন। ধর্ষণের আগে তাদের ছেলে বন্ধুকে মারধর করা হয়, গাড়ির চাবি কেড়ে নিয়ে একটি ভিন্ন রুমে ওই বান্ধবীর সঙ্গে রাতভর আটকে রাখা হয়।

জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ওই তরুণী আরও বলেন, “সকালে আমার যে ফ্রেন্ডকে অন্য ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল, তার গাড়ির চাবিটা আমাদের দিয়ে ওরা (ধর্ষকরা) বলে, ‘ওদের বল, ওরা যেন আগে চলে যায়।’ আমরা বলি একসঙ্গে এসেছি, একসঙ্গেই যাব। কিন্তু আমাদের যেতে দেয়নি। এমনকি ওদের (বন্ধুদের) সঙ্গে কথাও বলতে দেয়নি। শুধু চাবিটা আমার বন্ধুকে দিয়ে আসি।”

ওই তরুণী বলেন, ‘ওই রুমের সঙ্গে যে ওয়াশরুম ছিল, সেখানকার সেলফের পেছনে নাকি একটা ডোর ট্র্যাপ ছিল। সেটা সরালে বেডরুমে কী হচ্ছে- সবকিছু দেখা যায়। এটা সাফাত আমাদের বলেছিল। পুলিশ সেটাও খুঁজে দেখতে পারে। এভাবে ডোর ট্র্যাপ রাখা তো আইনত অন্যায়।’

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘হোটেলের কেউ-ই আমাদের কোনো হেল্প করছে না। ওরা যদি হেল্প না করে তাহলে আমরা জাস্টিজ পাব কী করে?’

সেই রাতে ‘ধর্ষকরা’ নিজেদের প্রভাবের কথা জানিয়ে ভুক্তভোগীদের সাবধান করে দেয়। সে সময় তারা জানায়, সাফাত একদিন মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর সময় দুজনকে চাপা দিয়েছিল। কিন্তু পারিবারিক প্রভাবের কারণে কার গাড়িতে সেই দুজন চাপা পড়ে মারা যায়, সেটা ধরাই পড়েনি।

ওই তরুণী জানান, অন্যায় করে পার পাওয়া এমন অনেক কাহিনি ধর্ষকরা আমাদের শুনিয়েছে। আমরা এটাও পুলিশকে বলেছি।

‘হোটেলের ওই রুম নাকি সাফাত প্রায়ই ভাড়া নিত। ওই রুমে ওই ডোর ট্র্যাপটা বের করলেও তো একটা ক্লু পাওয়া যায়। পুলিশ কি সেটা চেক করেছে’- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘটনার পরদিন ধর্ষকরা আবার দেখা করার জন্য ভিকটিমদের একজনকে ১৮ বার ফোন করে। দেখা করতে রাজি না হলে তিন-চারদিন পর তার বাসায় ওদের গানম্যানকে (দেহরক্ষী) পাঠানো হয়। বাসায় কয়জন থাকে, ওর (ভিকটিমের) বাবা কী করে, কে কখন বাসায় থাকে, কখন থাকে না- গানম্যান এসব জানতে এসেছিল।

মাহিনের পরিচয় জানতে যোগাযোগ করা হলে দ্য রেইন ট্রি হোটেলের এক্সিকিউটিভ (ইন্টারনাল অপারেশন) ফারজান আরা রিমি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাহিন হারুণ নামে আমাদের হোটেলের একজন ডিরেক্টর (পরিচালক) রয়েছেন।’

ঘটনার রাতে তিনি হোটেলে উপস্থিত ছিলেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন তো আপনাকে বলতে পারব না, তিনি ছিলেন কিনা। এখন মেমোরিতে (স্মৃতিতে) নেই। উই ডোন্ট হ্যাভ দ্য সিসিটিভি ফুজেট। উই নিড টু সি দ্য রেজিস্টার। (আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ নেই। রেজিস্টার দেখে বলতে হবে।)’

রেজিস্টার দেখে জানানো যাবে কিনা জানতে চাইলে হোটেলের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারা বিষয়টি তদন্ত করছে।’

জেপি/এমএমএ/এমএআর/জেআইএম