ভ্রমণ

পাহাড়ি ঝরনার সঙ্গে একদিন : প্রথম পর্ব

গত ৫ বছর ধরে প্রতি ঈদের পরের দিনই আমরা বের হয়ে পড়ি প্রকৃতি দেখতে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমাদের ভ্রমণের একটা গ্রুপও আছে। যারা কি না মুখিয়ে থাকি, কবে ঈদ আসবে আর আমরা বেরিয়ে পড়ব মুক্ত পাখির মতো। আমাদের এক বন্ধুকে আমরা ‘মিনি গুগল’ বলে থাকি। সে হচ্ছে আমাদের রুবেল। ও চেনে না বাংলাদেশের এমন কোন ট্যুরিস্ট স্পট নেই। রুট প্ল্যান করার কাজ হচ্ছে তার।

Advertisement

প্ল্যানটা করা হয়েছিল রমজানের শুরুতেই। যেহেতু ঈদের পরের দিনই আমাদের বের হয়ে পড়তে হবে। তাই ঈদের আগেই বাসের টিকিটসহ সব কেনাকাটা সেরে রাখার দায়িত্ব ছিল অর্জুনের। আমাদের রুট প্ল্যান ছিল সীতাকুণ্ড- মীরসরাই-কুপিকাটাকুম-বান্দর কুম-নাপিত্তাছড়া ঝরনা।

গত ঈদের পরের দিন রাত ৮টার মধ্যেই সবাই ঢাকায় পৌঁছে গেলাম (যারা ঈদে গ্রামে গিয়েছিলাম)। আমরা ১৪ জনের একটা গ্রুপ গিয়েছিলাম ভ্রমণে। রাত সাড়ে ১০টার বাসে উঠে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে কিছুদূর গিয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝখানে নূরজাহান রেস্তোরোঁয় হাল্কা কিছু খেয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম। একটা সময় দেখলাম, সুপারভাইজার এসে ডাকছে। আমরা নেমে পড়লাম। কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করলাম, আমদের যে জায়গায় নামার কথা ছিল, তার থেকে ৩ কিলোমিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। তখন আর কিছু করার ছিল না।

সবাই হাঁটতে শুরু করলাম। পৌঁছে গেলাম অলংকার মোড়ে। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়লাম মীরসরাই যাওয়ার জন্য। নাস্তা করে একটা মিনিবাস ঠিক করলাম মীরসরাইয়ের জন্য। মীরসরাই নেমে প্রথমেই একজন গাইড ভাড়া করে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই দুপুরের খাবারের জন্য অর্ডার করে গেলাম কিছু অ্যাডভান্সসহ।

Advertisement

যাত্রা শুরু হয়ে গেলো। রেলক্রসিং পার হয়ে গ্রামের মেঠোপথে কিছুক্ষণ যেতে যেতেই পাহাড়ি রাস্তা শুরু। বৃষ্টি হচ্ছিলো। আর আমি ভয় পাচ্ছিলাম জোঁকের। কিছুদূর যেতেই ঝিরি পথ শুরু। ছোট-বড় পাথরের সারি, দুই পাশে পাহাড়। বৃষ্টির কারণে খুব পিচ্ছিল হয়েছিল পাথরগুলো। সবাইকে সাবধান করছিল আমাদের দলনেতা রুবেল। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম রুবেলের কোন সাড়া-শব্দ নেই। ও পা পিছলে পড়ে গিয়ে অনেক ব্যথা পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই রুবেলকে ম্যাসাজ করতে থাকি। একপর্যায়ে ও আবার হাঁটতে শুরু করে।

আমরা প্রথমেই যেটা দেখলাম; সেটা দেখে মনে হলো- পাহাড়ের কোলে ঝরনার রানি শাড়ির আঁচল বিছিয়ে আছে। আর এটার নাম হলো কুপিকাটাকুম। এর একটু উপরেই বিশাল এক ঝরনা রয়েছে তবে অবস্থানটা এমন যে আমরা শুধু কুমেই নামতে পারবো; ঝরনার নিচে যেতে পারব না। তাই আর এখানে সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে এগোতে থাকি।

এবার পাহাড়ের পথ, কিছুটা ট্রেকিং। যদিও আমরা খেজুর, কিসমিস, স্যালাইন, গ্লুকোজ আর খাবার পানি সঙ্গে নিয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরপর আমরা বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। কারণ আমাদের গ্রুপের অনেকেই নতুন ছিল; যারা কি না আগে পাহাড়ি পথ পেরোয়নি। পাহাড়ি পথের ১৫-২০ মিনিট পরেই আবার ঝিরি পথ। পাহাড়ি ঝিরি পথ ধরে হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল- অনন্তকাল ধরে হেঁটে যাই এই পথে। পাহাড়ি পথের তুলনায় ঝিরি পথে হাঁটতে ক্লান্তি কম লাগে।

ঝিরি পথে ১৫-২০ মিনিট যাওয়ার পরেই নাপিত্তাছড়া। ক্লান্ত দেহে প্রশান্তি এলো নাপিত্তাছড়ার শীতল জলে। সেদিন বৃষ্টি ছিল বলে পানির প্রবাহটা অনেক বেশি ছিল। সবাই খুব হৈ-হুল্লোড় করছিলাম। আমাদের মধ্যে জুয়েল ছিল সবচেয়ে বেশি আবেগী। কিছুক্ষণ পর পর ও ভিডিও করছিল। আর লুৎফর তো সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাপিত্তাছড়ার অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করলো। সারাদিনের ক্লান্তি মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল। মনে হলো- থাকি না আরো কিছুক্ষণ। কিছুটা সময়, কিছুটা কাল।

Advertisement

কিন্তু এবার তো ফেরার পালা, চাইলেও আর থাকা সম্ভব নয়। তবে ফেরার সময় আমাদের আরেকটি আকর্ষণ, সেটি হল- বান্দরকুম। বান্দরকুমে যেতেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করতে হয়েছিল। এখানেও ঝিরি পথে কোথাও অনেক গভীর আবার কোথাও অনেক ঝোপঝাড়, পিচ্ছিল পাথরে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল ট্রেইলটা। কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে গেলাম বান্দরকুম ঝরনায়। ঝরনাটি সরু হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ছে, মনে হচ্ছিল- আমাদের এই কষ্টের দিনের পরিপূর্ণতা দিতেই মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন এই বান্দরকুম ঝরনা।

আবহাওয়া খারাপের দিকে যাচ্ছিল বলে দ্রুত খুব সতর্কতার সঙ্গে ফিরছিলাম সেই একই পথ ধরে। একটা সময় যখন পাহাড় ছেড়ে সমতলে আসলাম; তখন ক্ষুধায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। আবারো রেলক্রসিং করে চলে আসলাম সেই হোটেলে, যেখানে খাবারের অর্ডার করা ছিল। খাবার শেষে একটা লেগুনা ঠিক করে চলে আসলাম অলংকার মোড়ে আমাদের হোটলে।

চলবে-

এসইউ/পিআর