রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বন্ধুদের যোগসাজশে ধর্ষণের ঘটনায় তরুণীর করা মামলার তিন দিন পার হলেও ৫ আসামির কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
Advertisement
আসামির পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তারা (আসামিরা) বাসাতেই রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভাইবার, ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে দুই জন আসামিকে সক্রিয়ও পাওয়া গেছে। তবুও পুলিশ বলছে, অভিযান চালিয়ে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, ধর্ষণের ঘটনাটি মামলা দায়েরের পর থেকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সোমবার দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি, উত্তর) উপ-কমিশননার শেখ নাজমুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করা গেছে। আসামিরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তাদের গ্রেফতার করা হবে, ছাড় দেয়া হবে না।
ডিবি উত্তরের ডিসি নাজমুল আরও বলেন, অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। আসামিরা যাতে পালাতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
Advertisement
আসামিরা কেউ যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সে জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার প্রধান আসামি সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ জানান, তার ছেলে সাফাত আহমেদ ঢাকাতেই আছে। নিয়মিতই সে তাদের গুলশানের বাসায় যাওয়া-আসা করছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্তও বাসাতেই ছিল।
দিলদার আহমেদ আরও বলেন, পুলিশ তাদের বাসায় গিয়ে কথাও বলেছে। সে সময়ও সাফাত বাসায় ছিল। তবে গতকাল সন্ধ্যার পর সাফাত বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পেলে তারা ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
তবে ধর্ষণের শিকার এক তরুণী জানান, আসামিরা পালিয়ে বিদেশ চলে যেতে পারে। আসামিরা প্রভাবশালী। গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকাও দিতে পারেন তারা। মামলার তদন্তে গড়িমসি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
Advertisement
অন্যদিকে ধর্ষণ মামলা নিতে পুলিশের কালক্ষেপণ ও তদন্তে গড়িমসির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ৫ জনের ৩ জনই প্রভাবশালী পরিবারের। বাকি দুইজন সাফাত আহমেদের দেহরক্ষী ও গাড়িচালক। এদের মধ্যে সাদমান সাকিফ রেগনাম গ্রুপের পরিচালক। তার বন্ধু সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে।
অপর আসামি নাঈম আশরাফ একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান চালান। নাঈমের সঙ্গে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করেছেন এমন কয়েকজন জানান, নাঈম আশরাফ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলে। ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে নাঈমের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই সুযোগে নাঈম নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতার ছেলে বলে দাবি করেন। রেইনট্রি হোটেলে রুম বুকিং করার সময়ও প্রভাবশালী বাবার নাম বলে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া শুধুমাত্র ভিজিটিং কার্ড আর ফোন নম্বর দিয়ে রুম বুকিং করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে এসে কনসার্ট করে যাওয়া গায়িকা ও অভিনেত্রীদের কয়েকটি অনুষ্ঠান আয়োজনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নাঈম। তিনি মিরপুর থাকেন। দুই তরুণীর ভাষায়, ‘ধর্ষণের দিন সবচেয়ে বেশি নোংরামি করেছিল নাঈম’।
সাফাতের পারিবারিক সূত্র জানায়, সাফাত আহমেদ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনায় স্নাতক পাস করে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। তিনি পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করেন। তবে গত মার্চে স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। সাফাতের সাবেক স্ত্রীই ওই দুই শিক্ষার্থীকে সেদিন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পাঠিয়েছিলেন বলে দাবি করে দিলদার আহমেদ বলেন, সাফাতের সাবেক স্ত্রীই থানায় হাজির থেকে ওই তরুণীকে দিয়ে এ মামলা করিয়েছেন।
তবে সাফাতের সাবেক স্ত্রী জানান, সাফাতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে গত ৮ মার্চ। তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও সাফাত আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। ওই মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময়ও জানতেন না সাফাতের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয়েছে। ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হওয়ায় দিলদার আহমেদ অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এ ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন বলে জানান সাফাতের সাবেক স্ত্রী।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক আবদুল মতিন জাগো নিউজকে বলেন, মামলার আসামিদের কাউকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। আমরা তদন্ত করছি। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেফতারেরও চেষ্টা চলছে। সাফাতের বাসায় সারা দিনে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। ওই বাসায় গেলে সাফাতের বাবার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। অন্য আসামিদের ধরতেও সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে। খুব শিগগিরই আসামিদের ধরা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে সাফাত আহমেদ নামে এক বন্ধুর জন্মদিনে যোগ দিতে গিয়েই বন্ধুদের যোগসাজশে ধর্ষণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণী। ওই ঘটনার ৪০ দিন পর ৬ মে (শনিবার) সন্ধ্যায় বনানী থানায় ৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।
আসামিরা হচ্ছেন- সাদনান সাকিফ, তার বন্ধু সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও তার দেহরক্ষী (নাম পাওয়া যায়নি)।
মামলা দায়েরের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ওই দুই তরুণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ধর্ষণের আলমত সংগ্রহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাক্তার সোহেল মাহমুদ। তিনি জানান, ধর্ষণের ঘটনাটি প্রায় দেড় মাস আগের, সে জন্য আদৌও কোনো আলামত পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
জেইউ/এআরএস/জেআইএম