জানি না এই লেখা আমি কার জন্য বা কার উদ্দেশে লিখছি। কিন্তু কথাটাতো আমাকে রীতিমতো খুঁচিয়ে আহত করছে, তাই না লিখেও পারছিনে। কথা হলো, এই একবিংশ শতকেও নারীকে কেন ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে? আমরা স্বীকার করছি যে, বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে, উন্নয়নে প্রভূত অগ্রগতি সাধন করেছে। আবার এখনও এখানে প্রায় বাল্যবিবাহকে অনুমোদন করে এরকম আইনও আছে, তবুও এদেশে নারীর অগ্রগতি সত্যি সত্যিই লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এতোকিছুর পরও সমাজে নারীরা কেন এতো ভয়ের ভেতর দিনাতিপাত করে বলুনতো? কেন এ প্রশ্ন তুলছি? দাঁড়ান বলছি।
Advertisement
গত কয়েকদিন বেশ কয়েকটি ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। প্রত্যক্ষ ঘটনাটি এরকম। এক পরিচিত ছোটবোন। মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসে পার্লারে কাজ নিয়েছিল। তখন পরিচয় হয় এক লোকের সঙ্গে। পরিচয়, পরিণয় ও বিয়ে দ্রুতই ঘটে যায়। এবং সন্তানও আসে দ্রুতই। লোকটি তখনও কিছু করতো না। মেয়েটি পার্লারে কাজ করে এবং তার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেয়েদের সাজিয়ে দিয়ে বেশ উপার্জন শুরু করে। ছেলেকে গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে রেখে আসে কাজের সুবিধার্থে। অনেক ধরে-করে ছেলেটিকেও একটি স্থায়ী চাকুরি জুটিয়ে দেয় মেয়েটি। এবং তারপর থেকেই ঘটতে থাকে বিপত্তি।
ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে অসততা শুরু করে, গোপনে অনেকগুলো সম্পর্কে জড়ায় ফলে অশান্তি শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়িতে গড়ায়। সন্তানকে মায়ের কাছে রেখেই ছেলেটি মেয়েটিকে ডিভোর্স দেয়। শুরু হয় মেয়েটির ভয়ঙ্কর সংগ্রামের জীবন। কিন্তু সেও চলছিলো বেশ, মেয়েটির ভাই এরমধ্যে এক প্রবাসী ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে ঠিক করে। প্রবাসী ছেলে না বলে ‘লোক’ বলাই শ্রেয় কারণ তার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। আগের বিয়ে টেকেনি, তাই আরেকটি বিয়ে করে থিতু হতে চায়। মেয়েটি বিয়ের সময় আর কোনো শর্ত না দিয়ে কেবল একথাই বলে যে, ওর ছেলেটিকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু বিয়ে হতে না হতেই এই বয়স্ক লোকটি মেয়েটিকে তার উপার্জন লোকটির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। আর সেই সঙ্গে একাধিক সম্পর্কের বিষয়তো আছেই।
কিন্তু যখন মেয়েটি পুলিশের কাছে যেতে চায় তখন মেয়েটিকে ভয় দেখায় এই বলে যে, তার কাছে নাকি মেয়েটির ও তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও আছে, যা মেয়েটি পুলিশের কাছে গেলে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে। ভাবুন একবার, স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের ভিডিও নাকি বাজারে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটিকে অপমান করা হবে এবং তাতে নাকি লোকটির কিছুই হবে না, কারণ পুরুষ মানুষের এতে কিছু এসে যায় না। মেয়েটি ভয়ে অনেকদিন ধরে লোকটির এই ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ড মেনে নেয় এবং এই মাত্র কিছুদিন আগে অনেক বন্ধুর পরামর্শে আইনের আশ্রয় নিয়েছে, তাও সহ্যের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে।
Advertisement
এবার আসি পরোক্ষ ঘটনাটিতে। এটি অবশ্য এখন সবারই মুখে মুখে চালু ঘটনা। ঢাকা শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের কয়েকটি ছেলে ও তাদের পরিচারকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ দায়ের করেছে দুটি মেয়ে। ধর্ষণের ঘটনা যেদিন ঘটেছে সেদিন তারা এই অভিযোগ করেনি, করেছে প্রায় মাসখানেক পরে। কেন তারা এতোদিন এই অভিযোগ করেনি? কারণ, তাদেরকে এই বলে ভয় দেখানো হয়েছিল যে, ধর্ষণদৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করা আছে, তারা যদি আইনের আশ্রয় নেয় তাহলে সেগুলো প্রকাশ করে দেওয়া হবে। সেই একই কথা, সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে তারা মুখ খোলেনি। যে ভিডিওটিতে কেবল মেয়েগুলিই নয়, তাদেরকে যারা ধর্ষণ করেছে তারাও রয়েছে, সেই ধর্ষণের ভিডিও যদি প্রকাশিত হয় তাহলে কেন কেবল মেয়েদের সম্মানহানি ঘটবে? এই প্রশ্ন তুলে কোনো লাভ নেই, কারণ এটাই বাস্তবতা। এমনকি আর দশজন নারীও এই ভিডিও দেখে মেয়েটিকেই দোষ দেবে?
ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই প্রশ্নও উঠেছে যে, মেয়েগুলি কেন হোটেলে গিয়েছিল? আর হোটেলে যেহেতু গিয়েইছিল, সেহেতু তারা ভালো মেয়ে নয়। ভালো মেয়েরা এতো রাতে একা একা হোটেলে যায় না। ধর্ষণকারীর বাবাদের কেউ কেউ একথাও বলছেন যে, যা হয়েছে তা সম্মতিতেই হয়েছে, অতএব, ধর্ষণের অভিযোগের কোনো বৈধতা নেই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম উন্মুক্ত হওয়ায় বাঙালি-মানস এখন সত্যিই ন্যাংটো হয়ে গেছে, খুব সহজেই বাঙালি-মানস তার পোশাকহীন চেহারা দেখাতে পারে আমাদের। আর তাতে আমরা দেখতে বা বুঝতে পারি যে, কেন মেয়েদেরকে ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। কারণ তাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের নিন্দাই হয় বেশি এবং এই নিন্দায় মেয়েদেরকেও অংশ নিতে দেখা যায় অহরহ।
কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুলছে না যে, ধর্ষণ ধর্ষণই, এক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যা অগ্রহণযোগ্য। আর হোটেলে গিয়ে জন্মদিনের আয়োজনে যোগ দিলেই যে কোনো মেয়েকে কেন ধর্ষণের শিকার হতে হবে সেটি যতোক্ষণ না নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে সংঘঠিত হচ্ছে ততোক্ষণ কেউই বিষয়টি বুঝতে চাইবেন না। বরং যে বোঝাতে চাইবেন তাকে জেরা করা হবে কিংবা তাকেও ‘খারাপ মেয়ে’-র তকমা দেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, যদি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়াই দোষের হয় তাহলে এই সমাজেতো ছেলে-মেয়েতে জানাশোনাই বন্ধ হয়ে যাবে, এক হিসেবে সেটা হওয়াই ভালো তাহলে, নয়? তাতে হয়তো ধর্ষণের আশঙ্কা থাকবে না, কী বলেন? না থাকবে মাথা আর না থাকবে ব্যথা, ব্যথার জন্য মাথাটাই কেটে ফেলার মতো নিদান বটে!!
এই রাষ্ট্রে, এই সমাজে বা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মে নারী আসলে সর্বত্রই এই ‘ভয়’-এর শিকার। কোনোভাবেই নারীকে এই ভয় থেকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবার থেকে নারীকে ভয় দেখানো হচ্ছে যাতে বড় হতে হতে নারীটি ভয় পেতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর ভয় পেলে নারীর পক্ষে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে না, এটাই পরিবার থেকে নারীকে ভয় দেখানোর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এসব ভয়কে জয় করে কোনো নারী যদি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশও করে তাহলে তাকে ভয় দেখানো হয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। এক সরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার জানালেন যে, তিনি আর তার ব্রাঞ্চে নারী অফিসার চান না কারণ নারীদের নাকি হাজারো বায়নাক্কা আর সবচেয়ে বড় কথা হলো নারীরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়।
Advertisement
অনেক পরে আরো আলোচনায় জেনেছি যে, ওই ব্যাংক ম্যানেজারটির সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ীর অসাধু সম্পর্কের কারণে তাদেরকে নিয়ম বহির্ভূত সুযোগ দিয়ে ঋণ-বরাদ্দ দেয়ায় নারী কর্মকর্তারা সহযোগিতা করেননি এবং পরবর্তীতে ওই ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শো-কজ হয় এবং তার চাকুরি নিয়ে এখন টানাটানি চলছে। এক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল তা বলাই বাহুল্য, এবং এর মানে হচ্ছে নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিলে নারীরা সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে। যদিও আজকের বিষয় সেটি নয়, তবে এরকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া সম্ভব নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইতিবাচক প্রমাণাদির।
ফিরে যাই ধর্ষণ বা সম্পর্কের নিবিড়তার ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ‘ভয়’ দেখানো প্রসঙ্গে। এমন পরিবারকে আমি চিনি যে পরিবারের মেয়েটির এরকম ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং এখনও মেয়েটি বিদেশেই রয়ে গেছে। পরিবারটি তাদের কন্যা সন্তানকে বলতে গেলে ত্যাগই করেছে। যে প্রশ্ন আগেও তুলেছি, এই ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় কিংবা সামগ্রিক ভাবে এই যে সকল ‘ভয়’ দিয়ে নারীকে আঁটকে রাখার প্রবণতা এর থেকে নারীকে মুক্ত করবে কে? মূলতঃ দেশের আইন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীইতো, নাকি? কিন্তু তার আগে নারীকে ভয়মুক্ত করার দায় ও দায়িত্ব আসলে মূলতঃ নারীরই।
পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র এই ‘ভয়’ দিয়ে নারীকে তার বশে রাখতে চাইবে, আর এতে যদি নারীরও অংশগ্রহণ থাকে অর্থাৎ একজন নারীও নারীকে ভয় দেখানোর কাজে উৎসাহ দেন, হোটেলে যাওয়ার জন্য নারীকেই দায়ী করতে থাকেন তাহলে শেষাবধি জয় হয় সেই ‘ভয়ের’ই। তাই নারীকে প্রশ্ন করে নয়, কোনো মেয়ের ভিডিও যদি বাজারে ছাড়াও হয় তাহলে সেই ভিডিও দেখে নারীকে গাল না দিয়ে বিষয়টিকে নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা নারীকে ‘ভয়’ দেখিয়ে আটকে রাখার অস্ত্র হিসেবেই দেখা উচিত। পুরুষ এক্ষেত্রে যদি নারীটিকে দোষ না দেওয়ার মতো উদার হতে পারেন তো ভালো, আর না হলে পুরুষের এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করার দৃঢ়তা নারীকেই অর্জন করতে হবে। সুখের বিষয় হলো, নারীর প্রতি নারীর এই ‘সিস্টারসুলভ’ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাড়ছে, গড়ে উঠছে এক প্রতিবাদি প্ল্যাটফরম এবং সেটা রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মের গণ্ডির বাইরেই।
ঢাকা ৮ মে, সোমবার ২০১৭লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর