জাতীয়

রামপুরা ট্র্যাজেডি: টনক নড়েনি প্রশাসনের

রাজধানীর রামপুরার হাজীপাড়া ঝিলপাড়ে দোতলা টিনশেড বাড়ি দেবে গিয়ে ১২টি প্রাণ ঝরে গেলেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ওই বাড়িটি দেবে যাওয়ায় দেশব্যাপি তোলপাড় হলেও ঝিলপাড় ঘেঁষে আরও যেসব টিনশেড, আধা-পাকা বাড়ি গড়ে উঠেছে তা সরিয়ে নেয়নি প্রশাসন। স্থানীয়দের আশঙ্কা, আরো বেশ কয়েকটি টিনশেড বাড়ি রয়েছে ঝুঁকির মুখে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি কিংবা ভুমিকম্পে আবারো ঘটতে পারে বড় ধরণের দুর্ঘটনা। তবে সংশ্লিষ্টরা রীতিমতো দায়িত্ব এড়িয়ে চলছেন। স্থানীয় প্রশাসন এর দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। তাদের দাবি, অবৈধ বাড়ি কিংবা ভবন সরানোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিলের আড়াই কাঠা জায়গা দখল করে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ঘর তৈরি করেন মনিরুজ্জামান চৌধুরী। যিনি স্থানীয় যুবলীগের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি। তবে শুধু মনিরই নয়, আরও অনেকেই অবৈধভাবে ঝিলের উপর টিনশেডের বাড়ি তুলে ব্যবসা করছে। কিন্তু নিষেধ নেই স্থানীয় প্রশাসনের। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিয়মিত মাসোহারা পায় স্থানীয় প্রশাসন। আর এ কারণেই তারা কখনো ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে বাধা দেন না। অবৈধ বাড়ি ভাড়ার ব্যবসা চালানোর জন্য পুলিশের সাথেও বোঝাপড়া থাকে কথিত মালিকদের। তাই এ এলাকায় পুলিশের নজরদারি কম বলেও দাবি স্থানীয়দের। সরেজমিনে দেখা গেছে, রামপুরার ওই দুর্ঘটনার ঝিলটি নামেই ঝিল, ডোবা বললেও ভুল হবে না। ঝিলের দুর্গন্ধযুক্ত পানি কয়লার চেয়েও কালো। সন্ধ্যে হলেই যেখানে মশার অত্যাচার। এমন ঝিলের ঠিক পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট বড় টিনশেড ঘর, আধ-পাকা বিল্ডিং। এর এক কক্ষের মাসিক ভাড়া ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। তবে এর পাশেই অনেক বহুতল বাসায় এর কমেও বাসা পাওয়া যায়। তবুও চাহিদা এখানেই বেশি। সোমবার রামপুরা বউবাজার মাটির মসজিদ এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, অসংখ্য আবাসিক ভবনে ‘টু-লেট’ নোটিস ঝুলছে। জানা যায়, ৭/৮ হাজার টাকা ভাড়ায় ২ রুমের বাসা পাওয়া যায় এখানে। এক রুম সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার টাকা। তবুও ফাঁকা থাকে অনেক দালান বাড়ি। অথচ পাশেই ঝিলের ওপর তৈরি টিনের ওই সব খুপড়িবাড়ি ফাঁকা থাকে না কখনো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিলের ওপর এসব বাসায় উঠলে পাওয়া যায় ফ্রি কিছু অফার। ডিশ, বিদ্যুৎ ও পানি ফ্রি। রাতে রয়েছে নারী কিংবা মদের চাহিদা পূরণের অপার সুযোগও। এমন ঘরের ভাড়াটিয়া হলে বৈধ-অবৈধ সব ধরণের আয়ের সুযোগ মেলে এখানে। কাজের সুযোগ বলতে কি রকম?- জানতে চাইলে এক খুপড়িবাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সাত্তার বলেন, “বোঝেন না কি ধরণের কাজ? এই ধরেন, মাদক বিক্রি, অস্ত্র ব্যবসা, মিছিলে লোক সরবরাহ করা। কথা হয় মঞ্জু নামে আখের রস ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি জানান, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই তারাই বেছে নেন এসব খুপড়ি। তিনি বলেন, “আখের রস বেইচা ২ সন্তান আর বউকে নিয়া এখানে থাকি। পরে জানলাম খারাপ মানুষের বিচরণ এখানে। লোকজন আসে, মিছিল মিটিং-এ যেতে চাপ দেয়।” এতো কিছুর পরেও কেন এখানে জানতে চাইলে মঞ্জু বলেন, “কী আর করমু, রস বেচার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে যে, এই ডরেই বাসা ছাড়ি না।” দুর্ঘটনার পর পরিদর্শনে এসে স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা-১৭) একেএম রহমত উল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রামপুরা ট্র্যাজেডির ঘটনায় যেই জড়িত থাক ছাড় দেয়া হবে না। সব অবৈধ খুপড়ি বাড়ি ভেঙ্গে দেয়ার কথাও জানান তিনি। কিন্তু তাঁর ঘোষণার পরেও কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকা জেলা প্রশাসক শেখ তফাজ্জল হোসেন মিয়া জাগোনিউজকে জানান, সরকারি জমি দখল করে এসব অবৈধ বাড়ি বানানো হয়েছে কিনা তা জানতে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে। অভিযোগের সত্যতা মিললে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব বাড়ি যে গড়ে তোলা হয়েছে তা মানতে নারাজ রামপুরা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান। তিনি জাগোনিউজকে বলেন, “অনেকেই অনেক কথা বলে। সব অভিযোগ আমলে নেয়ার বিষয় না।” পুলিশ কোনো ধরণের মাসোহারা নেন না দাবি করে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেন জানান, “টিনশেডের ঘরগুলোর মালিক কারা, ঘরগুলো বৈধ না অবৈধ তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তবে স্থানীয়দের দাবি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সিটি কর্পোরেশন যারই দায়িত্ব হোক না কেন, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। উল্লেখ্য, গত ১৫ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর রামপুরার পূর্ব হাজীপাড়ার বৌবাজার সংলগ্ন ঝিলের ওপর নির্মিত দুই তলা টিনশেডের একটি বাড়ি দেবে যায়। এ ঘটনায় নিহত হন ১২ জন, আহত হন আরো অন্তত ৩০ জন। জেইউ/এসআরজে

Advertisement