আইন-আদালত

ষোড়শ সংশোধনী : মামলা শুনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ (১৬তম) সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানি শুরু হয়েছে। সোমবার আংশিক শুনানি শেষে মামলার কার্যক্রম আগামীকাল (মঙ্গলবার) পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আদালত।

Advertisement

শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষের করা সময় আবেদন নাকচ করে আদালত বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি শুনব। এদিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এমন মম্তব্য করেন।

এর আগে গত ৭ মার্চ রিটকারী ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়ের বক্তব্য শুনানির কথা থাকলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের হাতে ‘গুরুত্বপূর্ণ মামলা’থাকায় প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়েছিলেন। ওই দিন আদালত আজ (৮ মে) পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। সেই তারিখ অনুযায়ী আজ মামলার শুনানি শুরু হয়।

সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে শুনানির প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, অবকাশের আগেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলে শুনানির প্রস্তুতির জন্য লম্বা সময় দিয়েছিলাম। ফলে আজকেই শুনানি শুরু করবেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের মামলাগুলোকে সবসময়ই সুপ্রিম কোর্ট গুরুত্ব দেয়। এগুলো ফেলে রাখা হয় না। আজকে রায় পড়া শুরু করবেন। আপনি না পারলেও আপনার একজন সহকারী দিয়ে রায় পড়াবেন। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে সম্মতি দিলে বেলা সাড়ে ১১ টার সময় মামলা শুনানির জন্য রেখে আপিল বেঞ্চ বিরতিতে যায়।

Advertisement

বিরতির পর বিচারকরা এজলাসে আসন গ্রহণ করেন।অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে আপিল বিভাগের সকল বিচারকের উপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানির আরজি জানিয়ে সময় আবেদন করে বলেন, আমি দেশের বাইরে ছিলাম। তাছাড়া শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থও নই। ফলে আরও সময় প্রয়োজন।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ মামলার শুনানি চালিয়ে যাব। এর আগে আমরা সকল পক্ষকে লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। আপনাদেরও বলেছি। এরই মধ্যে আদালতের বন্ধু হিসেবে অ্যামিকাস কিউরি ও রিটকারীরা তাদের লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছেন। আপনাকেও লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করতে হবে।

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আপিল বিভাগের সকল বিচারকই এই মামলায় অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে আমরা হাইকোর্টের রায় পড়ে ফেলেছি। হাইকোর্টের রায়ে কোনো বিতর্কিত বক্তব্য আছে কি না সেটাও আমরা দেখব।

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবারও বলেন, আপনারা কী শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি দেখবেন না? তখন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, আপনাকে কে বলেছিল বিদেশ যেতে? আপনি কেন বিদেশ গেলেন? অবকাশের আগেই তো শুনানির প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়েছি আর এখন অসুস্থতার কথা বলছেন।

Advertisement

এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আজকে সংবাদপত্রে দেখলাম একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে হাসপাতাল থেকে এক বছর পর জেলে নিল। এই ধরনের অসুস্থ যদি আপনি হন, তাহলে সেটা দুঃখজনক। তখন বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া আবারও অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, এবারই কী প্রথম এ মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এসেছে? এর আগে একাধিকবার মামলাটি কার্যতালিকায় ছিল, আপনারা সময় নিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল তখন আবারও মামলাটির শুনানি মুলতবি রাখার আরজি জানান। প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, শুনানি মুলতবি করা হবে না।

এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা মামলার পেপারবুক থেকে হাইকোর্টের রায় পড়া শুরু করেন। শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ন্যায় বিচারের স্বার্থে আপিল বিভাগের সকল বিচারক এই মামলাটি শুনবে।

মুরাদ রেজা বলেন, এখন আপিল বিভাগের এই বেঞ্চে দু’জন বিচারক নেই। তবে এই মামলার যুক্তি উপস্থাপনের সময় যেন তাদের বেঞ্চে রাখা হয়। এরপর পুনরায় পেপারবুক থেকে রায় পড়া শুরু করেন আইনজীবী মুরাদ রেজা। এরপর বেলা সোয়া ১টার দিকে আদালতের অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কালকেও কি এই মামলা শুনবেন? আগামীকাল মঙ্গলবার তো এই আদালতে আপিল শুনানি হয়ে থাকে। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা কন্টিনিউ চলবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যে দু’জন বিচারপতি এই বেঞ্চে নেই। শুনানি শেষ করে ফেললে তারা কী শুনবেন? প্রধান বিচারপতি বলেন, তারাও বেঞ্চে আসবেন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না। তখন মুরাদ রেজা বলেন, কালকে হয়তো রায় পড়া শেষ হতে পারে। তবে মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হলে তাদের বেঞ্চে রাখবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের অবশ্যই রাখা হবে। আমরা সবসময়ই মামলা নিয়ে বিচারকদের মধ্যে ডিসিপ্লিন ওয়েতে আলোচনা করে থাকি।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যদি এই আলোচনার মাধ্যমে বিভক্ত রায় হতো তাহলে জুডিশিয়ারির জন্য হেলদি হতো। তখন বিচারক ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখন শুনানিই শেষ হলো না, কেন আপনি বিভক্ত রায়ের কথা বলছেন? তখন অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা অফিসার অব দ্য কোর্ট। আমরা প্রত্যেকেই দেশের মঙ্গল চাই।

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে ১২ জন আইনজীবীর ঘোষণা করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। তিন বছর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবীর করা একটি রিট আবেদনে দেয়া রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ করে রায় দেয়। রায়ে বলা হয়, ‘সংসদের মাধ্যমে বিচারকগণের অপসারণ প্রক্রিয়া ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা।’

প্রথম দিন আপিল শুনানি শুরু করার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত মামলাটি আজ তালিকাভুক্ত হয়েছে। যেহেতু এই মামলাটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাই রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমাদের চাওয়া ছিল আপিল বিভাগের সব  ক’জন বিচারপতি যেন মামলাটি শোনেন।’যেহেতু আপিলের দু’জন বিচারপতিরে মধ্যে একজন অসুস্থ এবং একজন ছুটিতে আছেন এ জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যেন ওই দু’জন বিচারপতি আসীন হওয়া পর্যন্ত শুনানি মুলতবি রাখা হয়।

প্রধান বিচারপতি আশ্বাস দিয়েছেন, আমাদের যখন সওয়াল-জবাব (যুক্তিতর্ক) হবে তখন ওই দু’জন বিচারপতিও অংশগ্রহণ করবেন। এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মামলার পেপারবুক পড়া শুরু করেছি। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক পড়েছেন। আংশিক পড়া হয়েছে বাকিটা আগামীকালও হবে। তিনি আরও বলেন, ‘অ্যামিকাস কিউরি যারা আছেন তাদের অনেকেই আদালতে লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছেন। তাছাড়া অনেকেই তাদের বক্তব্য জমা দেয়া ছাড়া আদালতে বক্তব্য পেশ করবেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মামলাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। আমি যেটা আগাগোড়া বলে আসছি সেটা হলো, সংবিধানের মূল ধারাতে ফিরে যাওয়ার জন্যই এই ষোলতম সংশোধনী। সংবিধানের মূলধারা যেটি, সেখানে যদি পার্লামেন্ট ফিরে যায় তাহলে আদালতের রিভিউয়ের কোনো রকম ক্ষমতা থাকে না। আমি আগাগোড়াই বলে আসছি, হাইকোর্টেও বলেছি, জুডিশিয়াল রিভিউয়ের প্রশ্ন তখনই আসে যখন দেয়্যার ইজ অ্যামেন্ডম্যান্ট অব দ্য কনস্টিটিউশন, যখন সংবিধান সংশোধন করা হয়। যেহেতু মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস এবং ফিরে যাওয়া হয়েছে সুতরাং সেটাকে আর অবৈধ বলে ঘোষণা করার কোনো অবকাশ নেই।’

এদিকে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত যে আইন পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছিল, যেটাকে চ্যালেঞ্জ করে আমরা রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট আইনটাকে বাতিল ঘোষণা করেছেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যে আপিল দায়ের করা হয়েছিল সেটার শুনানির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আজকে আবার সময় আবেদন করেছিলেন। আদালত সময় মঞ্জুর করেননি। এ আইনজীবী বলেন, আদালত বলেছেন মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ বলেই এর শুনানি হওয়া জরুরি। জনগুরুত্ব বিবেচনায় মামলাটির শুনানি প্রয়োজন। এদিকে আজকের শুনানির সময় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খানসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।

এফএইচ/এসএইচএস/ওআর/বিএ