ছেলেবেলায় একটি বিজ্ঞাপন দেখতাম টিভির পর্দায়, কিসের বিজ্ঞাপন এখন আর মনে নেই। তবে মনে আছে বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হতো মা বাবার একমাত্র ছেলে। যে কি না ছেলেবেলা থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও খেলাধুলার কারণে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে। সেইসব ছবি বাবা বাঁধাই করে রেখেছেন ফটো অ্যালবামে। কোনো এক আত্মীয় বেড়াতে এলে ছবির অ্যালবাম বের করে তাই দেখাচ্ছিলেন। ছবিগুলো সময় অনুসারে সাজানো।
Advertisement
এক পর্যায়ে দেখা যায় সেই গুণী ছেলেটিই বড় হয়ে কোনো এক মেয়ের মুখে এসিড ছুঁড়ে মেরেছে! পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে- এমন একটি ছবিও ছিল অ্যালবামে। আত্মীয় লোকটি বললেন, বাবা হয়ে আপনি ছেলেকে ধরিয়ে দিয়েছেন! বাবা তখন বললেন, অমানুষের জন্য আবার কিসের ভালোবাসা!
এমন সব দৃশ্য বুঝি বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়। বাস্তবচিত্র এদেশে অনেকটাই ভিন্ন। খুনি, ধর্ষক, এসিড নিক্ষেপকারী সন্তানকে বাবা নিজে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন এমন ঘটনা খুবই দুর্লভ। আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন দুইজন তরুণী। মামলাটি এখন পুলিশের তদন্তাধীন। আসামীরা পলাতক, পুলিশ তাদের খুঁজছে। এ অবস্থায় আপন জুয়েলার্সের মালিক বলছেন যা ঘটেছে, সমঝোতার ভিত্তিতেই ঘটেছে! বাবা হয়ে ছেলের অপকর্মের পক্ষে এমন নির্লজ্জ দালালিও কি সম্ভব! কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েও তিনি ছেলেকে সুশিক্ষায় মানুষ করতে পারেন নি। সে বিষয় নিয়ে কোনো লজ্জা বা অনুতাপও নেই! অর্থবিত্ত কি মানুষকে এতটাই অমানুষ করে দেয়!
কদিন আগে একটি ছবি দেখলাম পাহাড়ি এক আদিবাসী বাবার। হতদরিদ্র বাবা, গায়ে তার শতছিন্ন পোশাক। বয়স আর দরিদ্রতার ভারে নুয়ে পড়েছেন। স্ত্রী নেই, একমাত্র সন্তানকে তিনি শাকপাতা, কচুঘেচু বেচে সেই টাকা দিয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন। ছেলেটি তার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। ওই দরিদ্র বাবা, ওই শতছিন্ন পোশাক পরা বাবা, ওই বয়স আর দরিদ্রতার ভারে নুয়ে পড়া বাবার ছবিটা যতবার দেখি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মাথা নুয়ে আসে। অথচ এত বিশাল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও যে বাবা ছেলেকে মানুষ করতে পারেননি, ছেলের ধর্ষণের পক্ষে সাফাই গাইছেন, সেই বাবাকে আমরা কী করে শ্রদ্ধা জানাই!
Advertisement
সন্তানের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়ার অন্ধ মানসিকতা সন্তানটিকে ধীরে ধীরে আরো বড় অপরাধী করে তোলে। পিতৃস্নেহ ভালো, তবে অন্ধ পিতৃস্নেহ না সন্তান, না বাবা কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। বাবার টাকার পাহাড় আছে। আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে ধর্ষক ছেলেটিকে বাবা হয়তো বের করেও আনবেন। কিন্তু একজন বাবা হিসেবে তার সম্মানের জায়গাটি কোথায় থাকলো! ছেলেটি নিশ্চয়ই জেনে গেছে, শুধু ধর্ষণ কেন, এরপর খুনি হলেও বাবা তাকে সমর্থন দেবে, বাঁচাবে। ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাওয়া ব্যক্তিও কি অপরাধী নয়? একজন সফল ব্যবসায়ী একজন ব্যর্থ বাবা হয়ে বেঁচে থাকবেন শুধু তাই-ই নয়, তিনি পুত্রের অপরাধে সমর্থন জানিয়ে দেশের কীটপতঙ্গের সংখ্যা আরেকটি বাড়ালেন। অথচ চাইলেই তিনি ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকতে পারতেন!
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর
Advertisement