আজ পঁচিশে বৈশাখে আর নতুন করে কিইবা বলা যায় তাঁর তরে? তিনি দার্শনিক ছিলেন, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা তিনি জীবনরসের কবি ছিলেন। নারীর অন্তবিহীন মান-অভিমান, বিরহ- বেদনার তুলির রঙচ্ছটা ছিলেন তিনি। নারীর প্রেমের নীলাভ আকাশের মুক্ত বিহঙ্গী তিনি, নারীর সকল দীর্ঘশ্বাসের সুধারস তিনি, তিনি প্রেমের প্রেমময়ী অর্ঘ্য। অসীম-সসীমের মিলনকে তিনি অনুভব করেছেন প্রেমে ভালোবাসায়, রূপে রসে, গন্ধস্পর্শে, বিষাদে বেদনায়, সুখ-দুঃখে।
Advertisement
সেটা তিনি অনুভব করেছেন সর্বানুভূতির ভেতর দিয়ে। কিছুই তাঁর কাছে তুচ্ছ নয় তাই। পৃথিবীর তুচ্ছতম ধূলিকণাও কবির কাছে পরম উপভোগ্য হয়েছে। সবই অভিষিক্ত হয়েছে সৌন্দর্যের নব নব উৎসরসে। সাংসারিক প্রেম এবং ভালোবাসার বন্ধন পরিত্যাগ করে বৈরাগ্যের সাধনায় ব্রতী হওয়ায় নরনারীর মুক্তির পথ তিনি দেখেননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা, গান এবং লেখনীর মধ্য দিয়ে নানাভাবে এই সত্যকেই স্পষ্টতর করে তুলতে চেয়েছিলেন যে, পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য এবং মায়া মমতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে জীবনের একাকীত্বের মধ্যে মানুষের মুক্তি নেই। নারী এবং পুরুষ একে অপরের জন্যই তৈরি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই সত্ত্বা। এই দুই ভিন্ন সত্বার একক বন্ধনের মধ্যে দিয়েই মানুষের মুক্তি, জগতের সমৃদ্ধি লাভ।
রবীন্দ্রনাথের সেই আধ্যাত্মলোক প্রেমে ঘুরেফিরে এই একই আভাসই পাই আমরা, "এক কহে আরেকটি একা কই? শুভযোগে কবে হব দুহুঁ হায়!!" রবীন্দ্রনাথ যে সংসারের মধ্যে দিয়ে নারীকে উচ্চতার কোন স্তরে উঠিয়েছেন তা অনুধাবন করা একজন সাধারণ নারী পুরুষের পক্ষে অসম্ভব। একজন নারীর নিখাদ নারীসত্তা, পুরুষকে তার নিজের মধ্যে ধারণ করবার অলব্ধ ক্ষমতা আর অশাস্ত্রীয় জ্ঞানানুরাগ ছাড়া রবীন্দ্র প্রতিভার আবিষ্কার অসম্ভব। কারণ বুঝতে হবে রবীন্দ্রনাথ কেবল কোন শাস্ত্রীয় পরিণতি নয়, রবীন্দ্রনাথ একরাশ অনুভুতির সংঘবদ্ধকরণের পরিণতি। অনেকে যাকে অলীকতা বলে আখ্যায়িত করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা অনেকটা নারীসুলভ। তাই একজন নারীর পক্ষেই সম্ভব রবীন্দ্র মহিমার সামগ্রিক ভাবনাকে একত্রীকরণ। রবীন্দ্রনাথকে তাই একজন পুরুষের চাইতে একজন নারীর পক্ষেই বোঝা শ্রেয়।
সৃষ্টির অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কল্পনা করেছেন দ্বৈতসত্তারূপে। একজন কবির অন্তর ও অন্যজন কবির অন্তরপ্রেরণা, একজন সৃষ্টি, আরেকজন স্রষ্টা। যাকে কবি বারবার সম্বোধন করেছেন- ‘জীবনদেবতা, মানসসুন্দরী, লীলাময়ী এবং ছায়াসঙ্গিনীরূপে’। এই মহাপুরুষ কি অসাধারণ মহিমায় মহিমাময় করেছিলেন নরনারীরর যোগাযোগকে! রবীন্দ্র নারী নিজের প্রেমকে যাঁচাই করতে নিজেকে নিত্য নৈমিত্তিক বা গতানুগতিক প্রেমের সেই স্তরে নামিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করেনা যেখানে তাঁর প্রেমের অস্বীকৃতি হয়, যেখানে তাঁর নারীমর্যাদার এতটুকু ক্ষুণ্নহয়।
Advertisement
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট আরাধা নারী হৃদয়ের নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষায় প্রেমাসক্ত পুরুষকে দেবতা স্থির করে তাঁর চরণে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়, আর সেই দেবতা পুরুষের সকল মহিমা বাঁধা থাকে, সকল মুর্চ্ছনা দোলায়িত হয় তাঁর পূজারী নারীর গৌড়ীসম আঁচলের ছন্দের তালেতালে । এইসব কিছুই বাস্তবতা নয়, তবে এখান থেকে বিশুদ্ধ বাস্তবের ঈঙ্গিত পাওয়া কঠিন নয়। এ কথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথ কোন সহজ ব্যাপার নয়। তাই কেবল রবীন্দ্রনাথ পড়ে রবীন্দ্র মহিমাকে ধরা যায়না, যদিনা তিনি ধরা দেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে কখনো নারীকে পুরুষের চোখ দিয়ে দেখেননি।
নারীর ঐশ্বর্যকে ব্যাখ্যা করতে, নারীর অবস্থানকে মূল্যায়ন করতে তিনি নারীর রুপ ধারণ করে নিজেকে নারীর অবস্থানে নামিয়ে এনেছিলেন। "শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী, পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি" রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে যখন নারীকে "অর্ধ মানবী" বলছেন তখন নারীর আর অর্ধেক তিনি নিজেকেই দাবি করছেন পুরুষের রুপে এবং ঠিক সেই জায়গায় তিনি নিজেকেও অর্ধ মানব এবং অর্ধ সত্য বলে দাবি করছেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন নারী পুরুষ বাহ্যিকতার দিক থেকে আলাদা হলেও এদের লক্ষ্য দুই সত্তার একক রুপ। যার পরিণতি হিসেবে আমরা পাই নারী পুরুষের মিলনের মাধ্যমে আরেকটি সম্পূর্ণ নতুন জীবনের সৃষ্টি।
নজরুলের কাব্যে যেমন, "নর দিলো ক্ষুধা, নারী দিলো সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে, জম্ম লভিছে মহামানবের, মহাশিশু তিলে তিলে।" আমাদের উচিত রবীন্দ্রনাথকে তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করার চেষ্টা করা। একজন লেখককে জানতে গেলে তাঁর স্থান কালের ধারণা দিয়ে বিচার করতে হয়, তাঁর লেখা পড়তে হয়। উনি কটা প্রেম করেছেন বা কজন ওনার প্রেমে পড়েছিলেন সেটা মোটেও বিস্ময়কর নয়। এ কথা বোঝা কঠিন নয় যে রবীন্দ্রজীবন নারীহীন ছিলনা। প্রতিভাবান সুরসিক সুদর্শন মানুষটির সঙ্গসুখ লাভে দেশবিদেশের বহু মানুষই আগ্রহী ছিলেন, আগ্রহী ছিলেন আরো কতো গুণমুগ্ধ রমণীরাও। আর তাছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জীবনোচ্ছল, হৃদয়স্পর্শী ব্যক্তিত্ব নিশ্চই প্রেমহীন ছিলোনা। কিন্তু তবুও রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর প্রেম এবং তাঁর সৃষ্টিকে নিজের মাপে বিচার করার যোগ্যতা যদি কারো থেকে থাকে তবে সে কেবল রবীন্দ্রনাথেরই ছিলো। তাই আমাদের উচিত তাঁর শিল্পকে আত্মস্থকরণের প্রচেষ্টা করা যেখানে ছিলো তাঁর নিত্যকর্ম আর আত্মতৃপ্তি।
লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
Advertisement
এইচআর/পিআর