সুযোগ ছিল বলেই ফিরে এসেছিলেন। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের সময় একমাত্র ছেলে সাহিল প্রায় কোমায় চলে গিয়েছিল; কিন্তু শিশু পুত্রের অমন অসুস্থতাও তাকে দায়িত্ববোধ থেকে একচুল নড়াতে পারেনি।
Advertisement
মাশরাফি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড থেকে দেশে ফেরত আসেননি; কিন্তু এবার সুযোগ ছিল। এখনো আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্ট শুরুর বাকি পাঁচ দিন। তাই তো অসুস্থ্ স্ত্রীর পাশে ক`দিন কাটিয় গেলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। শনিবার রাতে দেশ ছেড়ে আবার দলের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে গিয়ে মিলিত হয়েছেন টাইগার অধিনায়ক।
জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা আরিফুর রহমান বাবুর সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন বেশ অনেকটা সময়। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ইংল্যান্ডের উইকেট, আবহাওয়া, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশের শক্তি-সম্ভাবনা, সম্ভাব্য টিম কম্বিনেশন- অনেক বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন মাশরাফি। যার পুরোটা একবারে শেষ করা যায় না। বাকিটুকুও আলাদাভাবে তুলে ধরা হবে পাঠকদের সামনে।
জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য মাশরাফির সেই সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ তুলে ধরা হলো...
Advertisement
জাগো নিউজ: ইংল্যান্ডের আবহাওয়া আর উইকেট কি চিন্তার কারণ?মাশরাফি : ঠিক চিন্তা বা শঙ্কার কারণ বলবো না। তবে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়া আর ধাতস্ত হওয়া- যাই বলুন না কেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ডে এখন দিনে গড়পড়তা তাপমাত্রা থাকছে ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকেল থেকে তাপমাত্র কমে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায়। আর রাতে আরও কমে ২ ডিগ্রিতে নেমে আসে।
আমাদের দেশে শীতকালেও অত ঠান্ডা পড়ে না। যা মানিয়ে নেয়া সত্যিই কঠিন। ওই ঠান্ডা আবাহওয়ার সাথে মানিয়ে নেয়া আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার ওপর পারফরমেন্স নির্ভর করে অনেকটাই।
নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে শুরুতে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে খানিক সমস্যা হয়েছে। আমাদের অবচেতন মনে আবহাওয়ার কথা বার বার মনে হতো। এ বিষয়টা বেশি ভাবতে গিয়ে উইকেটের চরিত্র ও গতি প্রকৃতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও মাথায় ছিল না। নিউজিল্যান্ডের পিচ ছিল একদম ফ্ল্যাট; কিন্তু আমরা উইকেট নিয়ে বেশি চিন্তা করতে গিয়ে ধরা খেয়েছি। প্রথম ম্যাচে সবার মাথায় উইকেট নিয়ে চিন্তা ছিল অনেক বেশি।
শেষ পর্যন্ত উইকেট নিয়ে ভাবতে ভাবতে নির্ভেজাল ও ব্যাটিং সহায়ক পিচে না বুঝে প্রথম ম্যাচ হেরেছিলাম। তবে ইংল্যান্ডে উইকেট নিয়ে চিন্তার কিছু দেখছি না। এটা আইসিসির ইভেন্ট। খেয়াল করে দেখবেন, যেখানে যে কন্ডিশনেই খেলা হোক না কেন, আইসিসির সব ইভেন্টেই উইকেট থাকে একদম ফ্ল্যাট। প্রটোকলই আছে উইকেট ফ্ল্যাট দিতে হবে। ইংল্যান্ডেও তেমনি থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। কাজেই আমার মনে হয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে উইকেট একদম ফ্লাট থাকবে।
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনার কি মনে হয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বোলারদের তুলনায় ব্যাটসম্যানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বেশি নিতে হবে? মূল কাজটা কি ব্যাটসম্যানদেরই পালন করতে হবে?
মাশরাফি : এটা করতেই হবে। আমার সাথে রিচার্ড হ্যলসলের (সহকারি কোচ) কথা হচ্ছিল। ইংলিশ রিচার্ড বলছিলেন, আমাদের যদি জিততে হয় তাহলে বেশির ভাগ ম্যাচে ২৮০ বা তার বেশি এমনকি ৩০০ রান চেজ করেও জিততে হতে পারে। আর আগে ব্যাট করেও ওই রানের আশপাশেই থাকতে হবে। বোলারদের লড়াকু পুঁজি দিতে হলেও রান ২৮০‘র আশ পাশে থাকতে হবে।
পাশাপাশি বোলারদেরও দায়িত্ব আছে। তাদেরও প্রতিপক্ষের রানটা ২৮০ এবং ২৯০ এর মধ্যে রাখতে হবে। সর্বোচ্চ ৩০০‘র মধ্যে রাখতে হবে। আবার প্রতিপক্ষ যদি ৩৩০ বা সাড়ে তিনশো করে ফেলে, তাহলে তো হবে না। কাজেই বোলারদেরও দায়িত্ব আছে। শুরুতে একটু বেশি উইকেট পেলে আড়াইশো কিংবা ২৩০-এর মধ্যে প্রতিপক্ষকে অলআউট করার চিন্তা ও লক্ষ্যও রাখতে হবে।
জাগো নিউজ : কম্বিনেশন কেমন হতে পারে? চার পেসার নিয়ে মাঠে নামার কোন সম্ভাবনা কি আছে?
মাশরাফি : ইংল্যান্ডে চার পেসার খেলিয়ে লাভ হবে না। উইকেট ফ্ল্যাট হবে। চার পেসার নিয়ে মাঠে নামার যৌক্তিকতা কম থাকবে। আমাদের প্রতিপক্ষগুলোতে দেখেন, ওদের দূর্বলতা কিন্তু স্পিনেই। বাংলাদেশের মাটিতে তিন পেসার খেলানো হচ্ছে। তাই বলে ইংল্যান্ডে গিয়ে চার পেসার নিয়ে মাঠে নামবো, বিষয়টা তেমন না। আর ব্যাটিং শক্তির কথাওতো ভাবতে হবে।
জাগো নিউজ : প্লেয়ারকে কেন্দ্র করে কম্বিনেশন না, নাকি কম্বিনেশনের ওপর ভিত্তি করে প্লেয়ার নির্বাচন?
মাশরাফি : টিমকে বেইজ করে কম্বিনেশন। প্রতিপক্ষ কোথায় শক্তিশালী, তার গঠন শৈলী কেমন? তাদের প্লাস-মাইনাস দেখে ও চিন্তা করেই আমার মনে হয় একাদশ সাজানো উচিৎ। উইকেট নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই। উইকেট মনে হয় না খুব বেশি ম্যাটার করে। আইসিসির কোন ইভেন্টে উইকেট তেমন ম্যাটার করে না। আমার ক্যারিয়ারে আটটা আইসিসির টুর্নামেন্ট খেলেছি। সাধারণত উইকেট ফ্ল্যাটই থাকে। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন কয়েকটা উইকেট হয়তো একটু অন্যরকম হতে পারে। অনেক সময় উইকেটও বিশ্রাম কম পায়। সে কারণে আবার কোন দল খুব বেশি খারাপ ব্যাটিং করলে ভিন্ন কথা। আমার কাছে মনে হয় প্রতিপক্ষ দলকে দেখে, তাদের গতি-প্রকৃতি মাথায় রেখে আমাদের নিজেদের দল সাজানো উচিৎ।
জাগো নিউজ : দুই বছর আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া বিশ্বকাপের পর আবার ৫০ ওভারের আইসিসি ইভেন্ট। নিজেকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন?
মাশরাফি : মোটিভেশনের কিছু নাই। যখন ২০১৫ সালে অধিনায়ক হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেছিলাম, তখনো তেমন কোন বিশেষ চিন্তা বা লক্ষ্য নির্ধারণ করে উদ্বুদ্ধ হইনি। নিজেকে ও রকম কোন জায়গায় দাঁড় করাইনি, যাতে অপ্রয়োজনীয় টেনসন তৈরি হয়। এবারো এত সাত-পাঁচ ভেবে যাচ্ছি না। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে অত-শত ভাবার ও মাথায় আনার প্রশ্নই আসে না। হ্যাঁ যেটা হতে পারে টিমের জন্য যেটা করার সেটা হতে পারে। সেটা করতেই হবে।
জাগো নিউজ : দু`বছর আগে যে দল নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন তা ছিল তারুণ্য নির্ভর। এবারের দলটি তুলনামূলক অভিজ্ঞ ও পরিণত, অধিনায়ক হিসেবে আপনার আস্থার জায়গাটা কি একটু বেশি?
মাশরাফি : ফর্মের ওপর নির্ভর করে। অভিজ্ঞতাও একটা বিষয়। আসল কথা হলো ফর্ম। দেখেন সৌম্য গত বছর ভাল খেলেনি। এবার ভাল খেলছে। ইমরুলও গত বছর পঞ্চাশ গড়ে ব্যাট করেছে। তামিমও তাই। মুশফিক রান করছে। এছাড়া বোলারদের মধ্যে সবাই কম বেশি উইকেট পেয়েছে। মোট কথা সবাই ভাল করছে বা সবাই ভাল খেলেছে; কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ডিফারেন্ট বল গেম। এখানে একদম নির্ধারিত দিন ও জায়গামত জ্বলে উঠতে হবে। সময়ের দাবি মেটাতে হবে।
মোদ্দা কথা, একদম ফর্মের চূড়োয় থাকতে হবে। এই টাইপের টুর্নামেন্টে আপনার অনেক বেশি ভালো খেলতে হবে। পেছন ফিরে তাকানোর সময় ও সুযোগ নেই। এই টাইেপের টুর্নামেন্টে পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে, আমি নির্ধারিত দিনে নিজেদের সেরাটা উপহার দিব। মাত্র আট দলের খেলা। আমার কাছে মনে হয় প্রতিটি ম্যাচই সেমিফাইনাল, ফাইনাল। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রচুর মানসিক চাপ থাকবে।
জাগো নিউজ : চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কি বাংলাদেশের গ্রুপটা একটু কঠিন? তিন প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড কি একটু বেশি শক্তিশালী?
মাশরাফি : হ্যাঁ অনেকটা তাই। একটা একটা করে বলি। ইংল্যান্ডের দিকে তাকান, দেখবেন ইংলিশরা এখন দারুণ এক দল। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে আমাদের কাছে হারের পর ইংলিশরা অন্যরকম দল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এসেও অনেক বেশি আক্রমণাত্বক খেলেছে। অবিশ্বাস্য। ওরা আমাদের প্রচুর বেগ দিয়েছে। আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবার সুযোগ দেয়নি। আর চাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলবে নিজেদের মাটিতে। নিকট অতীতে ইংলিশরা সব সময়ই কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী। আর সাম্প্রতিক সময় ঘরের মাঠে সফলও অনেক বেশি। দীর্ঘদিন হারেনি তারা।
আর অস্ট্রেলিয়ার কথা কি বলবো, সবসময়ই টাফ টিম। আইসিসির যে কোন ইভেন্ট মানে বিশ্বকাপ ও চাম্পিয়ন্স ট্রফির মত বিশ্ব মঞ্চে অজিরা আরও অন্যরকম এক দল। আমার তো মনে হয় অজি ক্রিকেটারদের জন্মই হয়- আইসিসির এই আসরগুলোর জন্য। বিশ্বকাপ, মিনি ওয়ার্ল্ডকাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি- এলেই দেখবেন অজিরা দূর্বার হয়ে ওঠে।
নিউজিল্যানকেও পিছিয়ে রাখার কোন উপায় নেই। কিউইরা এসব টুর্নামেন্টে বেশিরভাগ সময়ই সেমিফাইনাল খেলে।
জাগো নিউজ : তাহলে কি বাংলাদেশ খানিক আনলাকি?মাশরাফি : নাহ। তা বলার ও ভাবার অবকাশ নেই। আমি আনলাকি না ভেবে অন্যভাবে দেখতে চাই। আমার চোখে এটা বরং একটা অন্যরকম সুযোগ। নিজেদের সামর্থ্য ও বর্তমান অবস্থা মেলে ধরার একটা মোক্ষম সুযোগ। আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে এবং কোথায় যাচ্ছি- তা দেখানোর বড় জায়গা হতে পারে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।
জাগো নিউজ : তাহলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশাটা কেমন হওয়া উচিৎ?মাশরাফি : প্রথমতঃ প্রত্যাশার গ্রাফটা আকাশছোঁয়া না রেখে একদম মাটিতে রাখা উচিৎ। পরিবেশ- প্রতিপক্ষ আর সব বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমি বলবো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভালো কিছু করা অনেক কঠিন কাজ। তাই বলে অসম্ভব নয়। ভালো করা একদমই অসম্ভব- তা বলবো না। তবে ভাল করার সম্ভাবনা কম, এমন চিন্তা মাথায় রেখে খেললে চাপ কম থাকবে। ভালো খেলার সুযোগও বেশি থাকবে।
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম