আন্তর্জাতিক

কার হাতে উঠছে ফরাসি মশাল : প্রেমজয়ী ম্যাক্রোঁর নাকি লি পেনের

‘এগিয়ে চল’ আন্দোলনের নেতা ও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রান অফ পর্বের ভোটে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন বলে বেলজিয়ামের দৈনিক লি সোয়ের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। রোববার তিনটি ভোট জরিপকারী সংস্থার বরাত দিয়ে বেলজিয়ামের এই গণমাধ্যম উল্লেখ করেছে।

Advertisement

এতে বলা হয়েছে, মধ্যপন্থি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ৬০ শতাংশ অথবা তারও বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হতে পারেন। রোববার সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় রাত ৮টা।

দেশজুড়ে ৬৬ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে সকাল থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। দেশটিতে নিবন্ধিত ভোটার রয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ। ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে মধ্যপন্থি ম্যাক্রোঁ নাকি কট্টর ডানপন্থি লি পেন শেষ হাসি হাসবেন। এর আগে ২৩ এপ্রিল প্রথম পর্বের ভোটে ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩২৬ ভোট পেয়েছিলেন ম্যাক্রোঁ। কট্টর ডানপন্থি লি পেনের চেয়ে ১০ লাখের বেশি এই ভোট।

রোববারের এই নির্বাচনের জয়ী প্রার্থী বিভক্ত ফ্রান্সের মসনদে বসবেন। দেশটিতে বর্তমানে উচ্চ বেকারত্ব, নিশ্চল অর্থনীতি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। এর মাঝেই অভিবাসন ও একীভূতকরণ নীতির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আসছে দেশটির সরকার। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দিনের মধ্যভাগ পর্যন্ত ২৮ দশমিক ২৩ শতাংশ নিবন্ধিত ভোটার ভোট দিয়েছেন।

Advertisement

বিশ্লেষকরা বলছে, ভোটারদের কম অংশগ্রহণের এ চিত্র ভীতির কারণ হতে পারে ম্যাক্রোঁ শিবিরের জন্য। এতে লি পেনের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে ম্যাক্রোঁ। মধ্যপন্থি ম্যাক্রোঁ দেশটির ডান-বাম ভেদাভেদ ভুলে সেতুবন্ধন তৈরি করতে চান। ইইউ বিরোধী মনোভাবও ঠেকাতে চান তিনি।

তবে কট্টর ডানপন্থি ন্যাশনাল ফ্যন্টের প্রার্থী মেরিন লি পেন যদি এই নির্বাচনে জয় লাভ করেন; তাহলে ব্রেক্সিটের পর এবার ফ্রেক্সিট (ফ্রান্সের ইইউ ত্যাগ) এর মতো ঘটনা দেখা যেতে পারে। দুই সপ্তাহ আগের প্রথম পর্বের নির্বাচনে ভোটাররা ফ্রান্সের দীর্ঘদিনের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। প্রথম পর্বে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নেয়া ১১ প্রার্থীর মধ্যে ম্যাক্রোঁ ২৪ শতাংশ ও লি পেন ২১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, মতামত জরিপে লি পেনের চেয়ে ২৩ থেকে ২৬ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন ম্যাক্রোঁ। এর আগে গত মাসে দেশটির প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনের সময় যে মতামত জরিপগুলো উঠে এসেছিল; সেগুলো শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছে। গত বুধবার তিক্ত টেলিভিশন বিতর্কের পর ম্যাক্রোঁ তার প্রতিদ্বন্দ্বি লি পেনের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। দেশটির শেয়ার বাজারেও এর চাঙ্গা প্রভাব পড়ে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, স্থানীয় সময় রোববার সকাল ১২টা পর্যন্ত ২৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার কম। ইউরোপজুড়ে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে ফরাসি এ নির্বাচন।

Advertisement

দুই পর্বের এই ভোটাভুটিতে সোপ অপেরার মতো কিছু ঘটনাও আঘাত হেনেছে। একেবারে নির্বাচনী প্রচারণার শেষ মুহূর্তে এসে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে ম্যাক্রোঁ শিবির। তারা বলছে, ব্যাপক সমন্বিত হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণার অন্তিম মুহূর্তে শুক্রবার রাতে ম্যাক্রোঁর ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়ীক কাজের অন্তত ১৪.৫ গিগাবাইট ইমেইল ফাঁস করেছে নথি শেয়ারিং সাইট পেইস্টেবিন।

ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব নথির সঙ্গে ভূয়া নথি ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ম্যাক্রোঁর দল। তবে কারা এই সাইবার হামলার পেছনে জড়িত তা এখনও পরিষ্কার নয়।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নিজ দলীয় সমর্থকদের বাইরের ভোটারদের টানতে প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন কট্টরপন্থি লি পেন। একই সময়ে প্রথম রাউন্ডে এলিট শ্রেণির রাজনীতিকদের যে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির ভোটাররা; সেই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ভোটারদের নিজ শিবিরে টানার চেষ্টা করেছেন ম্যাক্রোঁ।

এদিকে ৩৯ বছর বয়সী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থি; একীভূতকরণ নীতির সঙ্গে তার জোরালো অবস্থানের অঙ্গীকার করে আসছেন নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকে। এর বিপরীত মেরুতে অবস্থান কট্টর ডানপন্থি লি’র। ৪৮ বছর বয়সী লি বলেছেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো থেকে ফ্রান্সকে বের করে আনা। কট্টরপন্থি এই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘণিষ্ঠ করারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

৫২ বছর বয়সী ভোটার প্যাসক্যাল বার্ডিন এই নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই ভোটের ওপর। সিএনএনকে তিনি বলেন, তবে এটি নির্ভর করছে ভোটে কি হচ্ছে তার ওপর, এই ভোট বিশ্ব নিরাপত্তা, জাতীয় স্থিতিশীলতা ও আমাদের মূল্যবোধের জন্য হুমকি হতে পারে।

দেশটির উত্তরাঞ্চলের শহর লি তোকুয়েতে ভাট দিয়েছেন ম্যাক্রোঁ। যেখানে তিনি এবং তার ৬২ বছর বয়সী স্ত্রী সমর্থকদের শুভেচ্ছা জানান। দেশটির উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হেনিন বিমন্টে ভোট দিয়েছেন লি পেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তুল্লে শহরে ভোট দিয়েছেন। গত কয়ক বছরে জঙ্গিদের প্রাণঘাতী হামলার ঢেউ বাড়লেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওঁলাদের জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত আছেন তিনি। তবে মধ্যপন্থি ম্যাক্রোঁর প্রতি তার সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন।

ফরাসি এই প্রেসিডেন্ট বলেছেন, অবশ্যই আমাদের সম্মুখে একটি রাস্তা আছে। এটি সেই রাস্তা; যা ফ্রান্সকে তৈরি করেছে। আমরা কখনোই পিছে ফিরে যাব না, সর্বদা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। উন্নয়নের জন্য সঠিক রাস্তা খুঁজছেন ফরাসিরা।

ফরাসি নির্বাচনের মশাল শেষ পর্যন্ত কার হাতে উঠতে যাচ্ছে; সেবিষয়ে চূড়ান্ত ফলাফলের আগে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। তবে ১৫ বছর বয়সে স্কুল শিক্ষিকার প্রেমে মজা ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর হাত ধরে যে ফ্রান্সের মূলধারার রাজনীতির মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে তা নির্বাচন পরবর্তী মতামত জরিপগুলোতেও উঠে এসেছে।

১৫ বছর বয়সে প্রেমে জড়িয়ে পড়লেও ম্যাক্রোঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি তার পরিবারের সদস্যরা। কয়েক বছর পরে তিন সন্তানের জননী ব্রিজিত্তে (৬৪) সাবেক ছাত্র ম্যাক্রোঁকে (৩৯) জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন, প্রথম স্বামীকে তালাক দেয়ার পর। প্রেমজয়ী ম্যাক্রোঁর হাতেই কী তবে উঠছে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মশাল!

এসআইএস/আরআইপি