বিশেষ প্রতিবেদন

শীর্ষ এক কর্মকর্তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ডিএসই

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বর্তমান প্রধান রেগুলেটরি কর্মকর্তা (সিআরও) এ কে এম জিয়াউল হাসান খান তার নিয়োগ নবায়নের জন্য প্রায় দ্বিগুণ বেতন-ভাতা চেয়ে বসেছেন, যা ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) চেয়েও বেশি। সিআরও’র এমন অস্বাভাবিক বেতন-ভাতা চাওয়ায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ডিএসই পরিচালনা পর্ষদ।

Advertisement

তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ভয়ে জিয়াউল হাসান খানের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করতে পারছে না ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। কারণ গুঞ্জন রয়েছে বিএসইসির ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে জিয়াউল হাসান খানের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে সামিট পাওয়ারের একীভূতকরণ ও রহিমা ফুডের মূল্যসংবেদনশীল তথ্যের ক্ষেত্রে করা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও পার পেয়ে যান ডিএসইর এই কর্মকর্তা।

ডিএসই পরিচালনা পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, সিআরও হিসেবে জিয়াউল হাসান খানের বর্তমান মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার (১১ মে)। যে কারণে গত ২৭ এপ্রিল ডিএসইর ৪৪৮তম বোর্ডসভায় সিআরও নিয়োগ নবায়নের বিষয় আলোচনা হয়। ওই বোর্ডসভায় সিআরও হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য জিয়াউল হাসান মাসিক বেতন-ভাতা চার লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে চেয়ে বসেন ছয় লাখ টাকা। অথচ ডিএসইর বর্তমান এমডি কে এ এম মাজেদুর রহমানের মাসিক বেতন-ভাতা পাঁচ লাখ টাকা।

এমডির চেয়ে বেশি বেতন-ভাতা চাওয়ার কারণে ডিএসই পরিচালনা পর্ষদ তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় জিয়াউল হাসান ডিএসই পর্ষদ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার এর থেকে বেশি বেতন-ভাতার অফার আছে। সুযোগ-সুবিধা না বাড়ালে আমি চলে যেতে বাধ্য হব।

Advertisement

এ পরিস্থিতিতে ডিএসই পর্ষদ থেকে মাসিক বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ বাড়ি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। তবে জিয়াউল হাসান তাতে রাজি হননি। ফলে সিআরও নিয়োগ নবায়নের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় ওই বোর্ডসভা।

এদিকে জিয়াউল হাসান খানের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা করারও অভিযোগ রয়েছে। সিআরও’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি গত ডিসেম্বর থেকে প্রায় আড়াই মাস দেশের বাইরে অবস্থান করেন। দেড় মাসের কিছু বেশি সময় ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর, বিদেশে অবস্থানকালেই তিনি প্রায় আরও এক মাস ছুটি বাড়িয়ে নেন। এ নিয়ে ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা ধরনের গুঞ্জনও সৃষ্টি হয়। এর আগে সি লেভেলের (সিআরও, সিএফও, সিটিও) কোনো কর্মকর্তার টানা এতদিন ছুটি কাটানোর রেকর্ড নেই।

অভিযোগ আছে, সামিট পাওয়ারের সঙ্গে একই গ্রুপের তিন কোম্পানি সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার, সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার এবং সামিট উত্তরাঞ্চল পাওয়ার একীভূতকরণ কার্যক্রম আদালতের নির্দেশনা মেনে হয়েছে কি-না, তা যাচাই না করেই কোম্পানিগুলো একীভূত হয়। এছাড়া সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ারকে তালিকাচ্যুত করার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বুঝিয়ে না দেয়া এবং একইসঙ্গে সামিট পাওয়ারের শেয়ার লেনদেন চালু রাখার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ডিএসই থেকে যে অনিয়ম করা হয় তার পেছনের মূল কলকাঠি নাড়েন সিআরও’র দায়িত্ব পালন করা জিয়াউল হাসান খান।

যে কারণে জিয়াউল হাসান খানসহ তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তের জন্য গত বছরের আগস্টে বিএসইসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন নিজামী ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমানকে ডেকে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে সব দায় উপ-মহাব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। আর জিয়াউল হাসান খানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। এতে একপর্যায়ে নিজাম উদ্দিন ডিএসইর চাকরি ছেড়ে দেন।

Advertisement

এছাড়া রহিমা ফুড কর্পোরেশন লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারের মালিকানা হস্তান্তরের মতো মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ নিয়েও গত বছর সিআরও’র বিরুদ্ধে লুকোচুরির অভিযোগ ওঠে। রহিমা ফুডের পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যেকে সিটি সুগার মিল ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে তাদের শেয়ার স্থানান্তরের ঘোষণা দেয় এবং সেই তথ্য ডিএসইকে জানায়। কিন্তু ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে সেই তথ্য প্রকাশ করা হয় দেরি করে। মালিকানা পরিবর্তনের মতো মূল্যসংবেদনশীল তথ্য দেরি করে প্রকাশ করায় ডিএসইর সিআরও’র বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ওঠে।

ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, সামিট পাওয়ার এবং রহিমা ফুড নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তার দায় অবশ্যই সিআরও’র উপর বর্তায়। কিন্তু সিআরও নিয়োগের বিষয়টি বিএসইসির হাতে। তাই আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। বিএসইর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্কও রয়েছে, যে কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে ডিএসইর অধিকাংশ পর্ষদ সদস্যই জিয়াউল হাসানকে সিআরও হিসেবে না রাখার পক্ষে।

ডিএসইর আরেক পরিচালক বলেন, বর্তমানে ডিএসইর যে অবস্থা তাতে রিজার্ভ ভেঙে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে হয়েছে। স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার নিয়েও সদস্যরা সংশয়ে আছেন। এ পরিস্থিতিতে আমরা খরচ কমানোর পক্ষে। কিন্তু সিআরও তার মাসিক বেতন-ভাতা দ্বিগুণ চেয়ে বসেছেন। এমনকি এমডির থেকেও বেশি চাচ্ছে। এটি কিছুতেই বাস্তবসম্মত নয়। আমরা তার চাহিদা মতো বেতন-ভাতা দিতে পারব না জানালে তিনি বলেন- আমার অন্য জায়গায় এর থেকে ভালো অফার আছে। বোর্ডের কাছে তিনি যেভাবে ওই অ্যাপরোচ করেছিলেন তা কিছুতেই ভদ্রোচিত ছিল না।

যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হাসান খান জাগো নিউজকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আপনার যা জানার এমডির কাছ থেকে জেনে নিন। তিনিই এ বিষয়ে কথা বলার মুখপাত্র।

এরপর ডিএসইর এমডি কে এ এম মাজেদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সিআরও নিয়ে যা হচ্ছে তা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর সঙ্গে শেয়ারবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের ভেতর পড়ে না। বোর্ড কাকে কী সুবিধা দেবে, কী সুবিধা দেবে না- তা ডিএসইর অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর সঙ্গে বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই।

ডিএসই পরিচালক রকিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা জিয়াউল হাসান খানকে সিআরও হিসেবে না রাখার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা তাকে ১৫ শতাংশ বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি, এতে তিনি রাজি হলে থাকবেন।

এমএএস/বিএ/এমএস