দেশজুড়ে

বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণই মিঠুর নেশা

গাইবান্ধা স্টেডিয়াম সংলগ্ন বধ্যভূমিতে পাক সেনাদের সঙ্গে থাকা এক দিন মজুরের কাছে শোনা মর্মস্পর্শী কাহিনী তোলপাড় তোলে গুল মোহাম্মদ চৌধুরী মিঠুর মনে। ঘটনাটি ছিল এরকম, মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধায় প্রবেশের পর হানাদাররা পালিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসী স্টেডিয়ামের ভেতরে একটি গণ কবরের মধ্য থেকে বেরিয়ে থাকা একজন তরুণীর মেহেদী রাঙানো হাত দেখতে পান। তাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছিলো। এই বিষয়টি মিঠুর মাথায় গেঁথে যায়। সেই থেকেই তীব্র ক্ষোভ আর বেদনাকে শক্তিতে পরিণত করে মিঠু কাজ শুরু করেন বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজতে তিনি ছুটতে থাকেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। খুঁজে বের করেন অসংখ্য বধ্যভূমি আর গণ কবর। মিঠু বুঝতে পারেন বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। তাই বধূভূমি আবিস্কারের নেশা পেয়ে বসে এই মানুষটাকে।                                      বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে কাজের বিষয়ে মিঠু জানান, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে বাম ঘরানার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। গাইবান্ধার সামাজিক রাজনৈতিক মহলে জিএম চৌধুরী মিঠু নামে পরিচিতি তার। সেই সময় থেকেই সাংগঠনিক পড়াশোনার পাশাপাশি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে কোন লেখা পেলেই পড়া শুরু করতেন। ছাত্র রাজনীতিতে জেলা পর্যায়ের নেতৃত্বে আসেন নব্বয়ের দশকে। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারের নেতা। ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন ধারণ করলেও ৭৫`র ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও তার তরুণ হৃদয়কে আলোড়িত করে। সেই চেতনা থেকেই ১৯৮৮ সালে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ডে। তিনি সংগঠনটির জেলা সভাপতি ও রাজশাহী বিভাগীয় আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। স্কুল-কলেজের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে তার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং ঘাতকদের বর্বরতা সম্পর্কে তারা খুব কম জানেন। তাদের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে না পারলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারবে না। স্থানীয় মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে ওইসব গণ কবর ও বধ্যভূমিতে শায়িত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা শুরু করেন। এই কাজের পাশাপাশি গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ করেন। বধ্যভূমি ও গণ কবরগুলোর দৈন্য দশা তাকে ব্যথিত করে। একা একা কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তাকে এক শ্রেণির মানুষ বিরূপ ভঙ্গিতে কথা বলতেন। অবৈধ দখলদারদের অব্যাহত হুমকির মুখেও থামেননি কখনো। তবে এক পর্যায়ে মিঠু কাজ করার জন্য সমমনাদের নিয়ে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।  ১৯৯৯ সালে গাইবান্ধা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক, আইনজীবিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে আহ্বান জানান মিঠু। সেই সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ ও ঘাতক দালালদের অপতৎপরতার ইতিহাস তিনিসহ অনেকেই আলোচনায় নিয়ে আসেন। মিঠুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গঠিত হয় `বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটি`। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই কমিটির কাজ হবে গাইবান্ধা জেলায় বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা অনুসন্ধান ও চিহ্নিত করা। পাশাপাশি তারা শহীদ পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করে তাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করবেন। সহযোগীদের নিয়ে কাজে নেমে বার বার বাধাগ্রস্ত হলেও অদম্য মিঠুকে কেউ দমাতে পারেনি। ৩০টি বধ্যভূমি ও গণকবর তিনি চিহ্নিত করেন। তবে এগুলোর বেহাল অবস্থা ও অবৈধ দখলদারদের কব্জায় থাকার বিষয়টি তাকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবি, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে একাত্তরের চেতনা ও স্মৃতি রক্ষার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানান। কেউ কেউ বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির দাবি ও আবেদন বিবেচনার আশ্বাস দিলেও অনেকেই ব্যাপারটিকে হালকাভাবে নেন। জিএম চৌধুরী মিঠুর জেদ চেপে বসে। তিনি রীতিমতো আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জেলার সাত উপজেলায় যেখানে যেখানে বধ্যভূমি রয়েছে সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানোর ব্যবস্থা করেন। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক উপজেলা প্রশাসন সীমিতভাবে হলেও বধ্যভূমি সংরক্ষণের কার্যক্রম হাতে নেয়। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। একের পর এক আবেদন করতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা ধর্মী কাজ করেন এমন অনেক বুদ্ধিজীবি ও সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিত্বদের কাছেও চিঠি লেখেন এবং তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মিঠুর কথা গভীর আন্তরিকতায় শোনেন লে. জে. শফিউল্লাহ, মে. জে. মাসুদ, ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসির মামুন, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, লে. জেনারেল হারুন উর রশিদ, লে. কর্নেল সাজ্জাদ, মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী, মফিদুল হকসহ অন্যরা। এই বিষয় নিয়ে কাজরে সুবাদে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দু`বার মিঠুর সাক্ষাৎকার ধারণ করে প্রচার করা হয়। কাজ পাগল মিঠুর সততা ও নিষ্ঠার কারণে ২০১১ সালে পৌরসভা নির্বাচনে এলাকাবাসীর ভোটে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এখন তিনি পৌরসভার প্যানেল মেয়র।মিঠু ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির সাফল্য অনেক। গাইবান্ধার বধ্যভূমি সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়। অনেক এলাকায় নতুন করে কাজ শুরু হয়। গাইবান্ধায় জেলা প্রশাসন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতি বছর ২৫ মার্চ কাল রাত্রি স্মরণে গাইবান্ধায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে আলোর মিছিল ও বধ্যভূমিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন। অসংখ্য মানুষ অংশ নেন এসব কর্মসূচিতে। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি, সাঘাটার মুক্তি নগরের গণ কবর, কাশিয়াবাড়ীর বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ব্যাপারে সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট জিএসএম আলমগীর জানান, গাইবান্ধার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সুবেদার আলতাফ হোসেন (বীর প্রতীক ও বীর উত্তম) ও সাব মেরিনার বদিউল আলম (বীর উত্তম) কিংবদন্তি তুল্য। তাদেরকে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে নিয়ে এসে মানুষের সামনে নতুন করে উপস্থাপনের ব্যাপারেও আমরা ভূমিকা পালন করেছি। গাইবান্ধার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বীরাঙ্গনাদের পরিচয় ও তাদের দুঃসহ দিন যাপনের স্মৃতি কথাও মিঠু ভাই সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। সাবেক মুক্তিযোদ্ধা জেলা ইউনিট কমান্ডার মাহমুদুল হক শাহাজাদা বলেন, বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির মাধ্যমে জিএম চৌধুরী মিঠু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে   উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তার এই কাজ নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে। জিএম চৌধুরী মিঠু ক্ষোভের সঙ্গে জাগো নিউজকে জানান, পলাশবাড়ী রেস্ট হাউজ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে অবহেলা ও পরিকল্পনাহীনতা থাকায় স্থানীয় লোকজন সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যেতে পারেন না। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন খ্যাতি অর্জনের অভিপ্রায় নেই। মুক্তিযুদ্ধকালে গাইবান্ধায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কিংবা হানাদারদের হত্যাযজ্ঞের সেইসব বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ এবং নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারীদের মর্যাদা দেয়া হলো না। বিষয়টি আমাকে সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অমিত দাশ/এমজেড/পিআর

Advertisement