ভ্রমণ

দেখে এলাম বান্দরবানের পাহাড়ি সৌন্দর্য

কয়েকদিন যাবৎ আলোচনা হচ্ছিল একটা ট্যুরের। ভ্রমণে আগ্রহী আমরা নিজ খরচেই যাব। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? পরে সবাই একমত হলাম যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান যাব। দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা , স্বর্ণমন্দির, চিম্বুক পাহাড়, শৈলপ্রপাত, সাঙ্গু নদী, রেমাক্রি ফলস, নাফাখুম, বগা লেক, কেওক্রাডং পাহাড়সহ অনেক নয়নাভিরাম স্থান। তিন-চার দিন থাকবো।

Advertisement

যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশজন শিক্ষার্থী যেতে রাজি হলাম। তারমধ্যে বিশজন অ্যানিম্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের একজন এবং কৃষি অনুষদের একজন। আমাদের আগ্রহে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডা. হাজ্জাজ বিন কবির স্যারও আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন।

২৪ এপ্রিল রাত আটটার দিকে শেকৃবির প্রধান ফটকের সামনে থেকে আমাদের জন্য অপেক্ষারত গাড়িতে উঠলাম। পরে সায়েদাবাদ থেকে বান্দরবানের বাসে আমাদের যাত্রা শুরু হল। পথে কুমিল্লায় বিরতি নেওয়া হয়। সারারাত কারো চোখে ঘুম নেই বললেই চলে। গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় করে রাত কেটে গেল।

ভোর পৌনে ৫টার দিকে আমরা বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম। তখনো আবছা অন্ধকার। কাছের একটা মসজিদ থেকে অনেকেই নামাজ পড়ে নিলো। তারপর পার্শ্ববর্তী হোটেল থেকে নাস্তা করে একযোগে বেরিয়ে পড়লাম ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। আমরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় জীপ নেওয়া হলো না। জীপে আবার ভাড়াও বেশি। দুটি চান্দের গাড়ি ভাড়া করা হল। চারদিকের নয়নাভিরাম পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্যের দৃশ্যগুলো উপভোগ করলাম সবাই। শৈলপ্রপাতে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নেওয়া হলো। তীব্র বেগে উপর থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে, যে দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেলফি এবং ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই।

Advertisement

এরপর নীলগিরিতে গিয়ে চারপাশের অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত সবাই। দূরের পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। মেঘ যেন পাহাড়কে ছুঁয়ে যায়। চিম্বুক পাহাড়ের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। দুপুরের দিকে আমরা থানচি পৌঁছলাম। থানায় অনুমতি নিয়ে আর একজন গাইড সঙ্গে নিয়ে কিছুক্ষণ বিরতির পর সাঙ্গু নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রেমাক্রির দিকে যাত্রা করলাম। দুই পাশের সুউচ্চ পাহাড়ের দৃশ্য কল্পনাতীত। নদীর দু’ধারে ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের চাই বা টুকরো চোখে পড়ার মতো। পানির নিচেও এরকম প্রচুর পাথর। সাবধানে নৌকা না চালালে বড় পাথরের সঙ্গে সংঘর্ষে নৌকার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নদীতে স্রোতও প্রচুর।

বিকেলে রেমাক্রি বাজারে পৌঁছানোর পর সেখানে একটি কটেজে উঠলাম। এলাকাটি বেশ অনগ্রসর। বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, মোবাইল ফোনেও নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বললেই চলে। যা হোক, তবুও আমরা রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। সাঙ্গু নদীতে সবাই ঝাপাঝাপি করে গোসল সারলাম। রেমাক্রি ফলসসহ এলাকাটি ঘুরে দেখা হল।

রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন খুব ভোরে গাইডকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নাফাখুম ঝরনা দেখার জন্য। দুর্গম পাহাড়ি পথ। প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যাগে রয়েছে খাবার, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার জন্য সঙ্গে একটি লাঠি নিলে বেশ কাজে লাগে। কয়েকঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছতে সক্ষম হলাম। কয়েকবার নদী পার হতে হয়েছে হেঁটে বা সাঁতার কেটে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পাহাড়ি বিষাক্ত সাপও চোখে পড়েছে কয়েকবার। কিছু স্থানে প্রায় সবাই জোঁকের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কাউকে কাউকে ১৫-১৬টি জোঁকও আক্রমণ করেছিল। পাহাড়ি বিপজ্জনক পাথুরে পথ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাই এগিয়ে গেছে। অবশ্য সবারই বেশ কষ্ট হয়েছে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে।

নাফাখুম পৌঁছানোর পর সব কষ্ট ভুলে যায় সবাই। আবারও আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। এ এলাকায় ভ্রমণের জন্য দক্ষ একজন গাইড দরকার। তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। বান্দরবানের উপজাতিরা জুম চাষ করে পাহাড়ি ঢালু জমিতে। প্রচুর কলা উৎপাদন হয়। বিভিন্ন ধরনের উপজাতি ও বাঙালিরা বসবাস করে বান্দরবানে।

Advertisement

পরদিন নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে রেমাক্রি থেকে থানচি হয়ে সরাসরি বান্দরবান পৌঁছলাম। হোটেলে রাত যাপন করে সকালে সবাই বের হলাম শহর দেখতে। এখানকার বার্মিজ মার্কেট বেশ বিখ্যাত। বার্মিজ মার্কেট থেকে সবাই প্রিয়জনদের জন্য বাহারি পণ্য কিনলো মনের আনন্দে।

তারপর বুদ্ধ ধাতু জাদী (স্বর্ণমন্দির), নীলগিরি, মেঘলার ঝুলন্ত ব্রিজসহ দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ শেষে রাতের গাড়িযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। পরদিন সকালে সবাই প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরলাম। বান্দরবানে একবার গিয়ে যেন মন ভরতে চায় না। তাই বারবার যেতে ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এসইউ/এমএস