অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইতোমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনের নামে সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য, সরকার কর্তৃক অবৈধ সিটিং সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা, পরবর্তীতে ফের চালুসহ নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যে এখন সময়ের দাবি- এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় পরিবহন এ বিশেষজ্ঞের। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ : আগের পর্বে নগরের পরিবহন, উন্নয়নের নানা সমস্যার কথা বলেছিলেন। গোটা দেশের চিত্র নিয়ে কিছু বলেন।ড. সামছুল হক : ঢাকার চাইতে চট্টগ্রামের অবস্থা আরও করুণ। চট্টগ্রামে আপনি ফ্লাইওভার ছাড়া কিছুই দেখতে পাবেন না। গণপরিবহনের নামগন্ধ নেই সেখানে। মাথায় পচন ধরলে তো অন্য অঙ্গও অকেজো হয়ে যায়। ঢাকায় তাও দু-একটি গণপরিবহন মিলছে। অন্য শহরে তাও নেই। ইজিবাইকের ছড়াছড়ি। সিএনজির দখলে রাস্তা।
পুরো দেশটা যদি একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে প্রত্যেকটি শহর হচ্ছে একেকটি ক্যান্সার সেল। ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রামগুলোও কথিত শহরের রূপ নেবে। তখন ক্যান্সার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না।
এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আর কোনো সরকারই ম্যানেজ করতে পারবে না।
Advertisement
জাগো নিউজ : এ ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই?ড. সামছুল হক : ঢাকা এখনও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। এরশাদ সরকারের নানা সমালোচনা আছে। কিন্তু তার আমলে কয়েকটি কাজ হয়েছিল, যা ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়ত করেছিল। প্রগতি সরণি, বিজয় সরণি, রোকেয়া সরণির মতো প্রাইমারি সড়কগুলো এরশাদের আমলেই করা। বেড়িবাঁধ, পান্থপথও তার আমলে করা। এরশাদ যাওয়ার পর আর কোনো সরকার কিন্তু প্রাইমারি সড়ক করেনি।
ঢাকা ছিল তেজগাঁও পর্যন্ত। এরশাদ এসেই রামপুরা সড়ক করে ঢাকা প্রসারিত করল। আশির দশকের কথা। এরপর আর কী হলো? এক বা আধা কিলোমিটার দূরে আরেকটি সড়ক হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কী হলো?
জাগো নিউজ : ‘না’ করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?ড. সামছুল হক : রাজনীতি। কথিত গণতন্ত্র আগে ভোটের হিসাবটাই করে। যেখানে উন্নয়ন করলে ভোট বাড়বে, চোখে দেখা যাবে, তা নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও নানা সমালোচনা আছে। আমরা কেউই এমন সরকার চাই না। এরপরও কথা থেকে যায়। তারা মাত্র দুই বছর ক্ষমতায় থাকল। হাতিরঝিল তারাই পেরেছে। কুড়িল, বনানী তারাই করেছে। সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল বিমানবন্দরের মধ্য দিয়ে একটি সড়ক করা। সেটিও সম্ভব হয়েছে তাদের আমলে। অথচ শক্তিশালী গণতন্ত্রের কথা বলেও মেট্রোরেল সেদিকে নিতে পারেনি।
Advertisement
জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসে এত বছর পরেও কেন একটি প্রাইমারি সড়ক করতে পারল না?
জাগো নিউজ : ঢাকার রূপ ফিরিয়েছে হাতিরঝিল। আপনি এ প্রজেক্টের সঙ্গে ছিলেন। কেমন দেখছেন?ড. সামছুল হক : প্রায় দখল হয়ে গিয়েছিল। সাত হাজার বস্তিবাসীর কবলে পড়ে হাতিরঝিল প্রায় বন্ধ তখন। ঝিল ভরা ময়লা-আবর্জনা। রাজনীতি হতো এখানেও।
আমি হাতিরঝিলের রাস্তার পরিকল্পনাকারী ছিলাম। আমাকে প্রথমে বলা হলো, আপনি মাঝখান দিয়ে শুধু ৮০ ফুটের একটি সড়ক বানিয়ে দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেই পরিকল্পনা বদলে দিল। তারা বলল, একটি রাস্তা কেন? ঝিল উদ্ধার করে চতুর্দিকে রাস্তা করার পরিকল্পনা করতে বলল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সাড়ে আট কিলোমিটার সড়কের পুরো নকশা আমি করে দিলাম। মানুষ ঘুরছে কিন্তু কোথাও থামতে হচ্ছে না। রাস্তা ঘুরেও বিরক্ত নন মানুষ।
তখন পারলে এখন পারছে না কেন? এখন সেনাবাহিনীর বাধা, নৌবাহিনীর বাধা, রাজনৈতিক দলের বাধা, অমুক গোষ্ঠীর বাধা।
জাগো নিউজ : তার মানে কথিত গণতন্ত্রই এখন জনস্বার্থবিরোধী?ড. সামছুল হক : আমি কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছি না। শুধু বলব, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয়। আরও দেশ আছে, সেখানে নগর আছে, উন্নয়ন হচ্ছে। তার তুলনায় আমরা কী করছি, সেটাই ভাবনার বিষয়। লোক দেখান উন্নয়ন ঘটিয়ে অপার সম্ভাবনা নষ্ট করার কোনও অধিকার সরকারের নেই। একইভাবে ডিকটেটেড উন্নয়নও করতে পারে না সরকার। করতেই হবে এমন মনোভাব জনস্বার্থে যায় না। বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন ঘটলেই জনস্বার্থ রক্ষা হয়।
জাগো নিউজ : এ অবস্থায় রাজধানী ঢাকার ভবিষ্যৎ কী?ড. সামছুল হক : রাজধানী স্থানান্তরের আর কোনো বিকল্প নেই। এমন এলোমেলো শহরে রাজধানী থাকতে পারে না। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এমনকি মিয়ানমারও রাজধানী পরিবর্তন করল। কারণ তারা দেখল একবিংশ শতাব্দীর রাজধানী আগের শহরে হতে পারে না। তারা আর সময় নেয়নি।
জাগো নিউজ : আপনার মতে কোথায় যেতে পারে রাজধানী?ড. সামছুল হক : একমাত্র ভালো একটি জায়গা ছিল পূর্বাচল। সেটিও আর নেই। পূর্বাচল, সাভার, ন্যাশনাল পার্কের পুরো এলাকা লাল মাটি দিয়ে তৈরি। অবকাঠামোর জন্য সহায়ক। সেখানকার মাটি শক্ত।
প্রতিষ্ঠান থাকলে, পেশাদার লোক থাকলে এত দিন রাজধানী স্থানান্তরের জন্য অস্থির হয়ে উঠত। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিজেই এখন ব্যবসার দোকান খুলে বসেছে। পূর্বাচল দখলে নিয়ে প্লট বিক্রি করে টাকা আয় করছে।
জাগো নিউজ : তাহলে রাজধানীর উপায় কী?ড. সামছুল হক : রাজধানী স্থানান্তর করতেই হবে। শুধু আমরাই বলছি না। দাতা সংস্থাগুলোও এখন নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রাজধানী স্থানান্তরের কথা বলছে।
অনেক দূরে হয়তো যেতে হবে। অধিক জনবসতির দেশ। তাতে আবার আশি শতাংশ জায়গা পলি মাটির। হয়তো কোনো চর এলাকা বেছে নিতে হবে। কিন্তু সেটা প্রাকৃতিকভাবে অর্থনৈতিক শহর হবে না। অনেক অর্থ ব্যয় করে সাজাতে হবে।
এএসএস/এমএআর/এমএস