নদীর ভাঙন তাণ্ডব ঠেকাতে ব্যর্থ হলে হয়তো দেশের মানচিত্র থেকেই দ্বীপ জেলা পিরোজপুরের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বলেশ্বর, সন্ধ্যা, কঁচা, তালতলা, কালিগঙ্গা, মধুমতি ও পোনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে ৭টি উপজেলায় ১৮টি বন্দর ও ৭৫টি গ্রাম হুমকির সম্মুখীন। তীব্র স্রোতে বিভিন্ন বাধে ভেঙেছে ২শ` ৫৮ কি.মি. জায়গা-জমি। সাগর উপকূলের জেলা পিরোজপুরের প্রায় ১৩ লক্ষ জন অধ্যুষিত মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বসবাস করতে হচ্ছে। একের পর এক ভাঙনে বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, মসজিদ, মন্দির ও জমি-জমা তলিয়ে যাচ্ছে রাক্ষুসি নদী গর্ভে। বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সহস্রাধিক পরিবার। দীর্ঘ ৬২ বছরে বিরতিহীন ভাঙনের ধারাবাহিকতায় উপকূলীয় উপজেলা নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) সন্ধ্যা নদীর প্রায় দুই যুগ ধরে ভাঙন অব্যাহত থাকায় দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে উপজেলার ১২টি গ্রামের মানচিত্র। সন্ধ্যার কড়ালগ্রাসে দক্ষিণ কৌরিখাড়া, সোহাগদল, গনমান, মুনিনাগ, জলাবাড়ী, উত্তর কৌরিখাড়া, বারড়া, শান্তিহার, ছারছীনা, কুনিয়ারী প্রভৃতি গ্রামের বাসিন্দারা বসত ভিটায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। গত ২৭ ও ২৮ মে দুই দিনে সন্ধ্যা নদীর আকস্মিক ভাঙনে দক্ষিণ কৌরিখাড়া লঞ্চঘাট সংলগ্ন ৭টি দোকান নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এবং ভাঙন কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল। সাম্প্রতিককালে গনমান গ্রামের পলি সল্ট ইন্ডিস্ট্রিজ, ৪টি বসতঘরসহ প্রায় ১ একর ফসলি জমি সন্ধ্যা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় ভাঙনের ফলে ওই সব গ্রামের শতশত পরিবার বসত ভিটা হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার একর ফসলি জমিসহ বিস্তীর্ণ জনপদ। পৈত্রিক ভিটা মাটি হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়েছেন। ভাঙন কবলিত এলাকায় এখনও অনেক পরিবার তাদের শেষ আশ্রয়স্থল বসত ভিটায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। স্বরূপকাঠি-পিরোজপুর সড়কের কামারকাঠি নামক স্থানে নদী ভাঙনের ফলে চরম ঝুঁকির মধ্যে যানবাহন চলাচল করছে। এদিকে ভাণ্ডারিয়ায় গত তিন বছর আগে তেলিখালী বাজারের ১২টি দোকান ও বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ ২ একর জমি কঁচা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতির আশঙ্কায় সেসময় ওই বাজার থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয় অনেক ব্যবসায়ী। জেলার নদীপথের প্রবেশদ্বার হুলারহাট নৌ-বন্দর কালিগঙ্গা ও কঁচা নদীর অব্যাহত ভাঙনে অস্তিত্ব বিলীন প্রায়। এছাড়া সদর উপজেলা শংকরপাশা ইউনিয়নের কঁচা নদীর অব্যাহত ভাঙনে পীর হাবিবুর রহমানের বাড়ির মসজিদ, বসত ঘর, গাজিপুর নেছারিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার বিভিন্ন অংশসহ একাধিক গ্রাম এখন হুমকির মুখে। অপরদিকে জেলা শহরের তীব্র ভাঙনে চাঁদমারি, বলেশ্বর ব্রীজ, পুরাতন ফেরিঘাট এলাকা হুমকির সম্মুখীন। উপকূলীয় উপজেলা জিয়ানগরের কচা ও বলেশ্বর নদীর অব্যাহত ভাঙনে চারাখালী খাদ্য গুদাম, গুচ্ছ গ্রামসহ একাধিক গ্রাম এখন হুমকির মুখে। ওই গ্রামের একজন বাসিন্দা জানান, আমাদের পৈত্রিক ভিটা বাড়িসহ শতাধিক বাড়ি ও প্রায় চারশাে বিঘা ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলার টগড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বৃটিশ আমলের জামে মসজিদসহ শতাধিক বাড়ি ইতোমধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বালিপাড়া ইউনিয়নের চণ্ডিপুর ও খোলপুটয়া গ্রামের কঁচা ও বলেশ্বর নদীর ভাঙনে ভিটা বাড়িসহ কৃষি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চারাখালী গ্রামের খাদ্য গুদাম, গুচ্ছ গ্রাম, ভাড়ানী খালের স্লুইচ গেটের দুই পাশের রাস্তা দিন দিন বলেশ্বর নদীতে ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এলাকাবাসীর ধানি জমি ও বসতবাড়ি হারিয়ে তারা এখন পথে বসার উপক্রম। পিরোজপুর জেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে আরও জানা যায়, জেলার উত্তরের জনপদ নাজিরপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত স্রোতস্বীনি মধুমতি গ্রাস করেছে মাটিভাঙ্গা ও শ্রীরামকাঠি বন্দরকে। এছাড়া তালতলা ও কালিগঙ্গা নদীর করাল গ্রাসে শাখারাকাঠী, মালিখালি ও দীর্ঘা গ্রামের বাজার, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে। মধুমতি নদীর ভাঙনে একই উপজেলার মিঠাকুল ঝনঝনিয়া, চাঁপাখালি, সাচিয়া ও লড়া গ্রামে দু`শতাধিক লোকের বসতবাড়িসহ আবাদি জমি, মাদ্রাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। তাছাড়া উপজেলার তালতলা নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে হোগলাবুনিয়াসহ আরো অর্ধশত গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন গৃহহারা হয়েছে। সন্ধ্যা নদীর অব্যাহত ভাঙনে স্বরূপকাঠি ও কাউখালী উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার। ভাঙনের ফলে স্বরূপকাঠি-বরিশাল সড়ক এখন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। তিন যুগের অধিক সময় ধরে নদী ভঙেন শুরু হলেও এ বছর ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে নেছারাবাদ শর্ষিণা পীরের বাড়ি, দরবার শরীফ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ কাউখালী বন্দর রয়েছে হুমকির মুখে। কাউখালী আশোয়া গ্রামের দুই পাশ থেকে বয়ে গেছে প্রমত্তা কঁচা ও গাবখান নদী। যৌথ নদীর মাঝখানে অবস্থিত আমরজুরি ইউনিয়নের প্রায় ৮ হাজার জনবসতি যার অধিকাংশ মানুষই হিন্দু সম্পদায়ের। মঠবাড়িয়া উপজেলা তুষখালী ও শাফা বন্দর দুটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তীব্র ভাঙনের ফলে তুষখালী লঞ্চঘাট এলাকা অনেককাংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অবিরাম ভাঙনে বন্দরের বহু দোকান ও বসতবাড়ি নদী গর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে । এছাড়া ইতোমধ্যে উপজেলার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সেখানকার স্টিমার ঘাটটিও।২০০৮ সালের ২৫ মে প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়াবহ জলোচ্ছাসের তাণ্ডব ঘটিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয় বেড়ি বাধ, ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তা-ঘাটসহ হাজার হাজার একর ফসলি জমি। ফলে অরক্ষিত ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে উপকূলের অত্র জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ। এদিকে প্রকৃতির রুদ্র হামলার শিকার ভাণ্ডারিয়া-চরখালি-পিরোজপুর সড়ক হুমকির সম্মুখীন। প্রবল বৃষ্টিপাতে ও জোয়ারের প্রচণ্ড চাপে ভাণ্ডারিয়ার তেলিখালি, মঠবাড়িয়া খেতাচিড়া ও ভোলমারা, জিয়ানগরের টগড়া ও সাউথখালি এবং সদর উপজেলার শারিকতলা এলাকায় কমপক্ষে ৮টি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাধ ভেঙে গেছে। আইলার পাঁচ বছরেও পিরোজপুর জেলার বিধ্বস্ত বাধগুলো এখনও সংস্কারবিহীন থাকায় উদ্বিগ্ন জেলাবাসী। পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট বেড়বাধের পরিমাণ ২শ` ৫৮কি. মি.। ঘূর্নিঝড় সিডর ও পরবর্তী আইলার জলোচ্ছাসে জেলার জিয়ানগর, পিরোজপুর সদর, মঠবাড়িয়া ও ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় বিধ্বস্ত ১শ`১১ কি.মি. বেড়িবাধের জন্য সরকারিভাবে এ পর্যন্ত মাত্র ৩ হাজার মে.ট. গম বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা দিয়ে মাত্র ১৮ কি. মি. বাধ মেরামত করা সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট বাধ এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত রয়েছে। এ সময় ৩০টি স্লুইস গেট সম্পূর্ণ ও ৪৩টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া আরও ৫শ` ২০ মিটার এলাকার তীর সংরক্ষণ সিসি ব্লক নদীতে ভেসে যায়, ক্লোজার নষ্ট হয় ১৭টি। বিধ্বস্ত পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে সেসময় বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বেড়িবাধের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে ছিল ২ হাজার ১শ` ৫০ কোটি টাকা। তবে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা তখন জানিয়েছিলেন, বেড়িবাধ নির্মাণেই কেবল প্রয়োজন ১৭ কোটি টাকা। আইলা ও সিডরের পর ক্ষতিগ্রস্থ বাধ ও অন্যান্য স্থাপনা মেরামত ও সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষ ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে প্রস্তাব পাঠালেও তা এখনও অন্ধকারেই রয়ে গেছে বলে সূত্র জানায়। এদিকে ভাঙন তাণ্ডব বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এনব ইউনিয়নের স্থায়িত্ব কাল নিয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। জেলার ভাঙনে জনপদগুলোর করুণ চিত্র দেখে মনে হয় আগামী ১০ বছরের মধ্যে জেলার মানচিত্র পাল্টে যাবে। ভাঙন রোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিটি সরকারের আমলেই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু কার্যক্রমে প্রতিশ্রুতি শুধু ঘোষণাই থেকে যায় বাস্তবায়িত হয় না। পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী উজ্জ্বল সেন জাগো নিউজকে বলেন, আমি সন্ধ্যার কড়ালগ্রাসে দক্ষিণ কৌরিখাড়া লঞ্চঘাট এলাকায় নদী ভাঙনের কথা শুনেছি। সন্ধ্যা নদীর ভাঙন রোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কারিগরি প্রতিবেদন পাঠানো হবে।এমজেড/পিআর
Advertisement