সারাদেশে রেলপথের উন্নয়ন ও দুর্ঘটনা ঠেকাতে উন্নতমানের এক হাজার ২০০টি লেভেল ক্রসিং গেট নির্মাণ প্রকল্পের মাত্র ১৯.৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
Advertisement
এভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প খুঁড়িয়ে চলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরও সময় চেয়েছে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রেল কর্তৃপক্ষ লেভেল ক্রসিংয়ের উন্নয়নে প্রকল্প হাতে নেয় ২০০৯ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদন পেতে সময় লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। রেলওয়ে ও পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। অবশেষে ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। অননুমোদিত ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে গেট দেয়া এবং কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে ৯৭ কোটি টাকার প্রকল্প দুটি চালু করা হয়। যদিও কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ আগামী জুন নাগাদ এর কাজ কোনোভাবে শেষ করা সম্ভব নয়।
রেলওয়ে ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গেট আর কর্মী নিয়োগের পরও ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে পথচারীদের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পারাপার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি পথচারীদেরও দায়িত্ব রয়েছে দেখেশুনে পথচলার। একই সঙ্গে তারা রেলের উন্নয়ন প্রকল্পটি খুঁড়িয়ে চলায় সংশ্লিষ্টদের সমালোচনাও করেন।
Advertisement
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং। কাগজে-কলমে মাত্র ৩৭১টির গেট থাকলেও নেই দুই হাজার ১৭০টির। বেশিরভাগ স্থানে নেই যান নিয়ন্ত্রণকর্মীও। নেই সংকেত বাতি।
প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে কিংবা দুর্ঘটনায় কাটা পড়ছে মানুষ। রেলগেট না থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন মানুষ।
রেলওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানায়, অপরিকল্পিতভাবে অনুমোদন ছাড়াই সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ সত্ত্বেও নাগরিকদের রেললাইনের উপর দিয়ে বেপরোয়া চলাচল রোধ করা যাচ্ছে না। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করায় লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এগুলোর কোনো অনুমোদন নেয়া হচ্ছে না। আবার সংশ্লিষ্টরা যাত্রীদের সুবিধার্থে ওড়াল সড়ক কিংবা ফুটওভারব্রিজ নির্মাণেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেল দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী।
Advertisement
বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলওয়ে পুলিশের দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অরক্ষিত ও সুরক্ষিত সব ধরনের লেভেল ক্রসিংয়ে পথচারীরা সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির শিকার হচ্ছেন। লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে কিংবা ধাক্কা খেয়ে প্রাণহানির ঘটনাও নিত্যদিনের।
গত রোববার সকালে মহাখালীতে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। শনিবার গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান হযরত আলী (৪৫) ও তার শিশুসন্তান আয়েশা (৭)। গত ৮ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার গোয়ালবাথানে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাইভেটকারের থাকা একই পরিবারের পাঁচ আরোহী মারা যান।
সর্বশেষ বুধবার সকালে অল্পের জন্য বড় ধরনের ট্রেনদুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান খিলগাঁও রেলগেট এলাকার মানুষ। খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় ওই সময় তীব্র যানজট দেখা দেয়। রেল লাইনের উপর স্থির দাঁড়িয়ে থাকে রিকশা, প্রাইভেটকারসহ বেশ কয়েকটি গণপরিবহন। চুল পরিমাণ জায়গা এগোবার অবস্থা নেই। হঠাৎ কমলাপুর স্টেশন থেকে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনকে ছুটে আসতে দেখা যায়। রেলের নিরাপত্তাকর্মী গেটের ব্যারিকেডও ফেলতে পারেননি। বাধ্য হয়ে দু’জন গেটম্যান লাল পতাকা হাতে নিয়ে প্রায় ২৫০ গজ সামনে গিয়ে পতাকা উড়িয়ে ট্রেন থামার সংকেত দেন। পরিস্থিতি অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে ট্রেনের চালকও গতি কমিয়ে দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে যানজটমুক্ত হলে আস্তে আস্তে ট্রেনটি রেলগেট এলাকা পার হয়।
রেলওয়ে পুলিশের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছর চার মাসে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুর) মারা গেছেন আট শতাধিক মানুষ। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করছেন আরও ছয় শতাধিক। শুধু রেলওয়ে পুলিশের কাগজ-কলমের হিসাব মতে, মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০ জন। শুধু চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৩ জন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, রেলের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে আগামীতে এ খাতে গতি আসবে। এলজিআরডি, সিটি কর্পোরেশন কিংবা সওজের উন্নয়নমূলক কাজের কারণে অবৈধভাবে নতুন নতুন পকেট গেট ও লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এসব কাজের বিষয়ে কোনো সমন্বয় হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আরও বড় বিপদ আমরা দেখতে পাব।
তিনি বলেন, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। এটি করতে না পারলে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা যেমন বাড়বে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে। তাই রেলপথ ও সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তার জন্যও বিনিয়োগ করতে হবে।
দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু সুপারিশও করেন এ বিশেষজ্ঞ। কম গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলো ধীরে ধীরে তুলে নেয়া, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নতুন কোনো লেভেল ক্রসিং নির্মাণ না করা, রাজধানীসহ ব্যস্ততম শহরগুলোতে রেল ও সড়কে যাতায়াতের জন্য আলাদা পথের ব্যবস্থা করা, একই পথে অন্তত উপর-নিচ করে রেললাইন ও সড়ক নির্মাণ করা এবং পথচারীদের জন্য জরুরিভিত্তিতে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা। সর্বোপরি মানুষকে পথ পারাপারে আরও সচেতন হতে হবে, তাহলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কমে আসবে।
উন্নতমানের লেভেল ক্রসিং গেট নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফিরোজ সালাহ্ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম রেলওয়ে বিভাগে দুটি প্রকল্প গত ২০০৯ সালে চালু হয়। কাজ শুরু হতে অনেক সময় লাগে। অবশেষে ২০১৫ সালে কাজ শুরু হয়। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয়েছে মাত্র ১৯.৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা কাজ শেষ করতে আরও সময় চেয়েছেন। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ধার্য বরাদ্দে কাজ শেষ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জনবল নিয়োগ প্রসঙ্গে রেলপথ সচিব বলেন, ইতোমধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চূড়ান্ত প্রার্থীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া যেকোনো মুহূর্তে শুরু হবে। এ নিয়োগ সম্পন্ন হলে রেলের জনবল সংকট অনেকটা দূর হবে।
জেইউ/এমএআর/এমএস