মতামত

বাড়িভাড়ার উপর সার্ভিস চার্জ!

ঢাকায় কর্মজীবীদের বেতনের একটি বড় অংশ চলে যায় বাড়ি ভাড়ার পেছনে। স্বল্প আয়ের মানুষরা বাড়ি ভাড়া দিতে নাকাল। এদিকে আবার প্রত্যেক বছরের শুরুতে বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর মহোৎসবে মেতে ওঠেন বাড়ির মালিকরা।দেশে বাড়ি ভাড়ার আইন থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মালিকরা তা মানছেন না। তোয়াক্কা করছে না ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্ধারণ করা বাড়ি ভাড়ার রেটের।

Advertisement

একদিকে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতি। যাতায়াত, লেখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ- সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা রাজধানীর সাধারণ মানুষের। তবে এখন বাড়ি ভাড়ার সাথে যুক্ত হয়েছে আরেক বিড়ম্বনার। যার নাম সার্ভিস চার্জ। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। বাড়ি ভাড়ার মূল টাকা ছাড়াও বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। লিফট, জেনারেটর, নিরাপত্তা প্রহরী এবং সিসি ক্যামেরাসহ অনান্য সেবা দেয়ার নামে এই চার্জ নিচ্ছে বাড়ির মালিকরা। কিন্তু চার্জ দিয়েও পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনও বাড়ি আছে যেখানে কোনো দারোয়ান নেই কিন্তু সার্ভিস চার্জের নামে দারোয়ান রাখার টাকাও দিতে হচ্ছে। পানি কিংবা বিদ্যুৎ বিল যত টাকাই হোক, বাড়িওয়ালা তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

অর্থাৎ বাড়ির মালিক যা বুঝাচ্ছেন ঠিক তাই বুঝতে হচ্ছে। মুখ বুজে পরিশোধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ এসবের প্রতিবাদ করতে গেলে পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন বাড়িওয়ালারা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে সেবা না পেয়েই ভাড়াটিয়ারা টাকা দিতে বাধ্য। বলা চলে বাড়িওয়ালাদের কাছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ জিম্মি। প্রতিবাদ করতে গেলেই যদি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়, তখন মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় কী!

সার্ভিস চার্জ নিয়ে এমনই বিড়ম্বনার শিকার রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকার ভাড়াটিয়ারা। নিয়মানুযায়ী লিফট, জেনারেটর, নিরাপত্তা প্রহরী এবং সিসি ক্যামেরাসহ অন্যান্য সেবা প্রদানের বিনিময়ে ফ্ল্যাটগুলোতে এই চার্জ নির্ধারণ করার কথা মালিকপক্ষের। অথচ বাড়ি ভাড়া আইনে বলা আছে, বাড়িওয়ালা যদি মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটের কাছ থেকে আদায় করেন, তাহলে প্রথমবার অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা মানছেন না কেউ।

Advertisement

অন্যদিকে চার্জ দিয়েও সেই অনুযায়ী সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িওয়ালারা ঝাড়ু দেয়ার জন্য ঝাড়ু বিল নেন কিন্তু ঝাড়ু দেয়া হয় না। উল্টো ঝাড়ু দিতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর তেমন চালানো হয় না, কিন্তু বাড়ির মালিক নিয়মিত ঠিকই জেনারেটর বিল নিচ্ছেন। গেটে দারোয়ান থাকে না, অপরিচিত সবাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় অথচ ঠিকই দারোয়ান বিল নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সব চার্জ দেয়ার পরও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাড়িওয়ালাদের বক্তব্য হলো দারোয়ান বিল, সিসি ক্যামেরা, লিফট, জেনারেটর সবকিছু এই ভাড়ার মধ্যেই থাকে। এসব চার্জ না দিলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে। আরও অনেক বাড়ি আছে সেগুলোতে উঠবেন। এছাড়া ফ্ল্যাট বড় হলে সব সুবিধা ভোগ করতে গেলে তো এসব চার্জ দিতেই হবে। বাড়ির মালিকদের কথা অনুযায়ী এক বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে গেলেও এই সার্ভিজ চার্জ থেকে রক্ষা নেই। কারণ সেখানেই তাদের মতোই বাড়িওয়ালারা আছেন। 

যদিও ভাড়াটিয়া পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের অবহেলার কারণে আর বাড়িওয়ালারা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে ৯০ শতাংশ ভাড়াটিয়াদের ওপরে এই নির্যাতন চলছে। বাড়িওয়ালাদের এমন খেয়ালখুশি মেনে না নিয়ে এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার পরামর্শ জানিয়েছেন তারা। প্রত্যেক মাসের শেষে এবং শুরুতে রাজধানীসহ সারা দেশের শহরগুলোতে চোখে পড়ে বাড়ি বদলের দৃশ্য। কিন্তু এই ঢাকা শহরের বাড়ি পরিবর্তন করার অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। বাড়ি বদলের জন্য ব্যাপক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়। তবে নতুন বাসা ভাড়া করতে গিয়ে পুরাতন বাসার চেয়ে সেখানে দ্বিগুণ জামানত গুণতে হয়। কাজেই ভাড়াটিয়াদের রক্ষা নেই। অনেকেরই বাসা বদলের পেছনে অন্যতম কারণ হলো বাড়া বৃদ্ধি ও অযৌক্তিক সার্ভিস চার্জ। ভাড়া বৃদ্ধি ও সার্ভিস চার্জের প্রতিবাদে আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসায় উঠেও কারোর স্বস্তি মিলে না?

কোটি মানুষের এই শহরসহ সারাদেশে বাড়ি ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখে যেন মনে হয়, এইসব অযৌক্তিক ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধির তদারকি করার জন্য কেউ নেই। যেভাবেই হোক সাধারণ মানুষের কল্যাণে ঢাকা শহরের বাড়ি ভাড়া আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। নতুবা মানুষের ভোগান্তি আরো বেড়ে যাবে। সার্ভিস চার্জ দিতে বাধা নেই, যদি সেই চার্জ যৌক্তিক এবং বৈধ উপায়ে নেয়া হয়। এই বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য। সার্ভিস চার্জ নেয়ার বিষয়টিকে নিয়মের মধ্যে না আনলে এ দুর্ভোগের কোনো সমাধান হবে না।

লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Advertisement

এইচআর/এমএস