দেশজুড়ে

‘মডেল উত্তরপত্র’ ডুবিয়েছে কুমিল্লা বোর্ডকে

‘প্রধান পরীক্ষকের কঠোর নির্দেশে দুই বার শিক্ষার্থীদের খাতার নম্বর কমাতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমি একজন অভিভাবক। চোখে ভাসছিল দশম শ্রেণিতে পড়া ছেলের মুখটি। আমি কি করছি, কিন্ত চাকরি রক্ষায় কিছুই করার ছিল না।’

Advertisement

এভাবে এসএসসি পরীক্ষায় একাধিকবার শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন ও নম্বর কমানোর ক্ষোভ জানান নগরীর একজন গণিত পরীক্ষক।

এ বছর দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে কুমিল্লা বোর্ডের স্থান একেবারেই তলানিতে। ফল বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কঠিন সৃজনশীল প্রশ্নপত্র ও অদক্ষ শিক্ষক এবং খাতা মূল্যায়নে মডেল উত্তর সরবরাহ করে পরীক্ষকদের কঠোর হুঁশিয়ারিসহ একাধিকবার উত্তরপত্রে নম্বর কমিয়ে আনার কারণে কুমিল্লা বোর্ডে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে চরম বিপর্যয় ঘটেছে বলে একাধিক পরীক্ষক দাবি করেছেন।

পরীক্ষকদের দাবি- বোর্ড কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই এ ফল বিপর্যয়। ইংরেজি ও গণিত পরীক্ষায় ফেল করেছে ৬০ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্র্থী এবং ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। তাই অস্বাভাবিক এ ফল বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানসহ পুনরায় খাতা মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

Advertisement

বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এ বছর কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে তিনটি বিভাগে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৭৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে এক লাখ ৮ হাজার ১১ জন। তিনটি বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে চার হাজার ৪৫০ জন। এ বছর বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। মানবিক বিভাগে পাসের হার ৪১ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাসের হার ৫৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ বছর এক হাজার ৬৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শতভাগ পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ১৪টি এবং দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করতে পারেনি। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতেও এ বছর পিছিয়ে কুমিল্লা বোর্ড।

২০১৬ সালে এ বোর্ডে মোট ছয় হাজার ৯৫৪ জন, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ১৯৫ জন, ২০১৪ সালে মোট ১০ হাজার ৯৪৫ জন এবং ২০১৩ সালে মোট সাত হাজার ৮৫৫ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল। এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্তির মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে চার হাজার ৩৩৮ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় মাত্র ৮২ জন এবং মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৩০ জন।

ফল বিপর্যয়ের কারণ

ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বছর ইংরেজিতে ফেল করেছে ২৫ হাজার ৬০৬ জন এবং গণিতে ফেল করেছে ৩৪ হাজার ৬৮৯ জন। ইংরেজি ও গণিতে বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ফেল করার কারণেই সকল বোর্ডের চেয়ে কুমিল্লা বোর্ডের ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে বলে দাবি করেছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর একটি বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষক জানান, ‘এ বছরের খাতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টিম দেখবে’ এই ভয় দেখিয়ে বোর্ড থেকে সরবরাহ করা উত্তরপত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মিলিয়ে খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রধান পরীক্ষকের নির্দেশে একাধিকবার খাতার নম্বর কমিয়ে ফেলতে হয়েছে।

তিনি আরও জানান, প্রধান পরীক্ষদের একটি প্যানেল বোর্ডের অদক্ষ কতিপয় কর্মকর্তার সহায়তায় খাতা দেখার নির্দেশিকা ও কথিত মডেল উত্তরপত্র প্রণয়ন করে খাতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষকদের নিকট সরবরাহ করে। পরবর্তীতে দেয়া হয় কঠোর নির্দেশনা, তাই অনিবার্য কারণে কুমিল্লা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য বিপর্যয় নেমে আসে, ফেলের তালিকায় স্থান পায় প্রায় ৪০ শতাংশ হতভাগ্য পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর।

এ বিষয়ে নগরীর খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোকসানা ফেরদৌস মজুমদার জানান, কঠিন সৃজনশীল প্রশ্নপত্র, সৃজনশীল বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র বিষয়ে মেধা কম থাকায় ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে।

নগরীর পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. তফাজ্জল হোসেন জানান, বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র তৈরি কিংবা মাঠ পর্যায়ে সৃজনশীল বিষয়ে সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের মতামত নেয় না, তাই বোর্ড কর্তৃপক্ষ নিজের পছন্দের স্কুলের শিক্ষকদের নিকট থেকে প্রশ্ন নিয়ে ইচ্ছেমতো প্রশ্ন প্রণয়ন করে, এছাড়াও বোর্ড থেকে এ বছর মডেল উত্তরপত্র পরীক্ষকদের নিকট সরবরাহ করায় মাঠ পর্যায়ে খাতা মূল্যায়নে জটিলতা সৃষ্টি হয়ে এ বছর ফল বিপর্যয় হয়েছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরীক্ষক বলেন, খাতা মূল্যায়নে আমাদের নিকট যে ধরনের উত্তরপত্র নির্দেশিকা সরবরাহ করা হয় তাতে সমস্যায় পড়তে হয়। বোর্ড থেকে সরবরাহ করা উত্তরপত্র অনুসারে খাতা দেখতে কঠোর হুঁশিয়ারিসহ কোনো কোনো পরীক্ষকের নিকট খাতা প্রধান পরীক্ষকরা খাতা ফেরত এনে নম্বর কমিয়ে ফেলতে বাধ্য করায় ফলাফলে চরম বিপর্যয় ঘটে।

এ ফল বিপর্যয়কে অস্বাভাবিক মন্তব্য করে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লা শাখার সভাপতি আলী আকবর মাসুম জানান, এ নিয়ে তদন্ত করে দেখা উচিত। খাতা মূল্যায়নের নির্দেশিকা, প্রধান পরীক্ষক ও বোর্ড কর্তৃপক্ষের ভূমিকা এবং মাঠ পর্যায়ে খাতা মূল্যায়নকারী সৃজনশীল বিষয়ে অদক্ষ পরীক্ষকের কারণে শিক্ষার্থীরা কেন খেসারত দেবে, এটা এখনই অনুসন্ধান করে পুনরায় ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণ করে ফলাফল প্রকাশ করা উচিত। কারণ উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের আরও বড় খেসারত দিতে হবে। এছাড়াও বোর্ড কর্তৃপক্ষের এ উদাসীনতার কারণে ফেল করা প্রায় ৪০ শতাংশ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তবে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর মো. আবদুস সালাম জানান, বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করলেও মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ফলাফল খারাপ হয়েছে। শুধুমাত্র গণিত ও ইংরেজি বিষয়েই ৬০ হাজরের বেশি পরীক্ষার্থী ফেল করায় গড় ফলাফলে কুমিল্লা বোর্ড পিছিয়ে পড়েছে। পরীক্ষকদের নিকট উত্তরপত্র সরবরাহ করায় খাতা মূল্যায়নে কিছুটা প্রভাব পড়েছে বলেও তিনি জানান।

আরএআর/বিএ