বিশেষ প্রতিবেদন

লাশের দেহে আঙুল দেবে গেল : রেশমা

রেশমা বেগম। সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী। ভবন ধসের ১৭ দিন পর বিশাল ধ্বংসস্তূপ থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। রেশমার উদ্ধারের ঘটনা ছিল মানব ইতিহাসের একটি বিস্ময়। সে সময় বিতর্কও উঠেছিল উদ্ধার অভিযান নিয়ে।

Advertisement

সুস্থ হওয়ার পর পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ রেশমার চাকরির ব্যবস্থা করেন। মধ্যস্থতা করেন রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া তৎকালীন সাভার ক্যান্টনমেন্টের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী।

এখন কেমন আছেন রেশমা? জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বর্তমান কর্মস্থল, রানা প্লাজার মৃত্যুকূপে ১৭ দিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা প্রথম ব্যক্ত করেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : রানা প্লাজার কোন ফ্লোরে আপনি কাজ করতেন?

Advertisement

রেশমা : রানা প্লাজার তিন নম্বর ফ্লোরে কাজ করতাম।

জাগো নিউজ : ভবন ধসের সময় কোথায় ছিলেন?

রেশমা : ঘটনার আগের দিন লাঞ্চের সময় বাসায় ফিরব বলে সকালে না খেয়েই বের হয়েছিলাম। ভবনে আসার পর অনেককে আলোচনা করতে দেখলাম। কেউ বলছেন, এত দিনের পুরান ভবন। সহজে ভাঙবে না। আবার কেউ কেউ কাজ না করেই বের হয়ে গেলেন। ভয়েই বের হলেন। আমরাও চলে এলাম।

পরের দিন যথারীতি কাজে গেলাম। দেখলাম, একটি বিম্বের পলেস্তারা খসে গেছে। বসরা কাজ করার নির্দেশ দিয়ে বলল, সমস্যা নাই, সবাই কাজ শুরু করে দাও।

Advertisement

জাগো নিউজ : কাজ শুরু করলেন?

রেশমা : কাজ শুরু করার পরপরই বিদ্যুৎ চলে গেল। পরে জেনারেটর চালু করল। তাও কয়েকবার বন্ধ হয়ে গেল। পরে বিদ্যুৎ আসল।

এর মধ্যে অনেকেই উপরে তাকিয়ে দেখেন ছাদে ফাটল ধরেছে। তখন সবাই কাজ বন্ধ করার জন্য হৈচৈ শুরু করে দেন। একপর্যায়ে সবাইকে ছুটি দেয়া হয়। সবাই হুড়োহুড়ি করে গেটের কাছে যাওয়া শুরু করেন। ভিড়ের কারণে আমি অপেক্ষা করছিলাম। ভাবছিলাম, রাস্তা কিছুটা ফাঁকা হলে আমি বের হব।

যেখানে কাজ করি, সেখান থেকে উঠে জুতা হাতে নিতেই পাশের আরেকজন আমাকে ডাক দেয়। ওর কারণেই বিলম্ব। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ভবন ভেঙে পড়ে। এরপর আর কি হয়েছে, তা বলতে পারব না।

জাগো নিউজ : গেটের কাছে যারা গিয়েছিলেন, তারা তো সবাই মারা পড়লেন?

রেশমা : কে মরল, কে বাঁচল, তার কিছুই বলতে পারব না।

জাগো নিউজ : চাকরিতে কবে যোগ দিয়েছিলেন রানা প্লাজায়?

রেশমা : ওই মাসেই কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এর আগেও ওখানে চাকরি করেছি। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। এরপর আবারও যোগ দেই।

জাগো নিউজ : কত টাকা বেতন পেতেন?

রেশমা : ছয় হাজার টাকা।

জাগো নিউজ : কী কাজ করতেন?

রেশমা : প্রথমে ওভারলুকের কাজ করতাম। পরে ফিনিশিংয়ে যোগ দেই।

জাগো নিউজ : যখন আটকা পড়লেন, তখন জ্ঞান ছিল?

রেশমা : না। ওই সময়ের কোনো কথাই মনে ছিল না। কত দিন পর জ্ঞান ফিরেছে, তাও বলতে পারব না।

জাগো নিউজ : যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আর কাউকে দেখতে পেলেন?

রেশমা : একেবারে অন্ধকার ছিল। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমার পাশে আরেক ভাই দেয়ালে আটকা পড়েন। তার চিৎকার শুনছিলাম তখন।

জাগো নিউজ : আপনার শরীরের কোনো অংশ চাপা পড়েনি?

রেশমা : না। আমার শরীরের কোনো অংশ দেয়ালের নিচে চাপা পড়েনি। বেঁচে থাকা পাশের ভাই আমার কাছে পানি চাইত। আমি বলতাম, পানি তো নেই। তার যে পা আটকা পড়েছিল, সেটি বের করার অনুরোধ করত। অনেক চেষ্টা করেছি। বের করতে পারিনি। শুধুই অন্ধকার ছিল।

জাগো নিউজ : কতটুকু জায়গা ছিল?

রেশমা : বসার কোনো জায়গা ছিল না। শুয়ে শুয়েই নড়াচড়া করতাম। এভাবে শুয়ে শুয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বসার মতো সামান্য জায়গা পেয়েছিলাম। অনেকেই আশপাশ থেকে বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করছিল। পাশে আটকা পড়া মিজান ভাই পানি পানি করে চিৎকার করতেন। কয়েক দিন পর তার চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। একসময় কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিলাম। তার দেহে হাতের আঙুল দেবে গেল। পরে বুঝলাম অনেক আগেই মারা গেছেন।

ডর-ভয় ছিল না। মাথায় তখন কোনো কাজ করছিল না। আজও মনে হলে আঁতকে উঠি।

জাগো নিউজ : লাশের গন্ধ বের হচ্ছিল না?

রেশমা : কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিছুই চোখে দেখতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি সেখান থেকে বের হওয়ার। যখন পারিনি, তখন হতাশ হয়েছি। মনে করেছি আমি মনে হয় আর বের হতে পারব না।

জাগো নিউজ : বেরিয়ে আসার জন্য কী ধরনের চেষ্টা করেছিলেন?

রেশমা : আমার আশপাশে ইটের ভাঙা টুকরা ছিল অনেক। সেগুলো সরাতাম। প্রচুর গরম ছিল। ঘেমে যেতাম। পানির পিপাসায় বুক ফেটে যেত।

কয়েক দিন পর হাতের কাছে একটি কাঁচি পাই। মাথায় তখন কাজ করল, কাঁচি দিয়ে কাটা যায় কিনা? মাথার কাছে অনেক কার্টন ছিল। কাপড় ছিল সেখানে। কাঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করলাম। কিন্তু কেটে কেটে শেষ করতে পারলাম না। যতই কাটি ততই কাপড়ের স্তূপ সামনে আসে। কাটতে কাটতে ফের আগের জায়গায় চলে আসি। সেই লাশের কাছে।

জাগো নিউজ : ঘুমাতেন না?

রেশমা : প্রচুর ঘুম আসত। অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। আবার ইট ভাঙা সরাতাম।

জাগো নিউজ : আপনাকে তো উদ্ধার করা হলো দোতলা থেকে?

রেশমা : ইট আর কাপড় সরাতে সরাতে একসময় একটু ফাঁকা জায়গা পেলাম। সেখান দিয়েই নিচে এলাম। সেখানে একটু প্রশস্ত জায়গা ছিল।

জাগো নিউজ :  সেখানে কি আলো ছিল?

রেশমা : না, সেখানেও কোনো আলো ছিল না। পরে সেখানে আলো আসে। উদ্ধারের আগে আলোর দেখা পাই। তবে সেখানকার ফ্লোরে প্রচুর পানি পেয়েছিলাম। পচা পানি নাকি ময়লা পানি, তা মনে করতে পারি না। পিপাসার কারণে সব ভুলে গিয়েছিলাম।

জাগো নিউজ : এখন কি মনে পড়ে?

রেশমা : মনে পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবলে অনেক কষ্ট হয়। যদিও ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্ট করেছি।

জাগো নিউজ : নিচের ফ্লোরে এসে আর কারও লাশ পেয়েছিলেন?

রেশমা :  না। সেখানে আর কোনো লাশের দেখা পাইনি।

জাগো নিউজ : উদ্ধারের আগে কেমন ছিলেন?

রেশমা : তখন আর নড়তে পারছিলাম না। শরীর আর চলছিল না। কাচ ভাঙায় কখন হাত কাটছে, কখন পা কাটছে, বুঝতে পারতাম না। বার বার মায়ের কথা, ভাই-বোনদের কথা মনে পড়ত তখন।

এরই মধ্যে হঠাৎ করে মাইকে ওয়াজের শব্দ শুনতে পাই। কখন রাত, কখন দিন কিছুই জানি না। এরপর একসময় ছিদ্র দিয়ে আলো দেখতে পেলাম। উপরের ইটভাঙা সরাচ্ছিল হয়ত। আর তখনই আলোর দেখা মিলল।

জাগো নিউজ : পরে কী করলেন?

রেশমা : আমি চিৎকার করলাম। কিছুক্ষণ পর ময়লা পড়ে ছিদ্র আবারও বন্ধ হয়ে গেল। তখন একটু সরে গেলাম। সেখানে গিয়ে আবারও ছিদ্র দিয়ে আলো দেখতে পেলাম। তখন আমার হাতে একটি লাঠির মতো পাইপ ছিল। পাইপ ভেঙে ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে চিৎকার করতে থাকলাম। কেউ শুনছে না। এভাবে আধাঘণ্টা। আমি লাঠিটা নাড়িয়েই যাচ্ছি।

একসময় একজন এসে বলল, স্যার এখানে মনে হয় কোনো জীবিত লোক আছে।

জাগো নিউজ : বাঁচার স্বপ্ন দেখলেন?

রেশমা : একজন এসে ছিদ্র দিয়ে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, আমাকে খাবার দিন? তারা প্রথমে পানি, বিস্কুট আর জুস দিলেন। বললেন, চিন্তা করেন না। আপনাকে জীবিত উদ্ধার করা হবে। আমার মা-বাবার নামও জানলেন।

জাগো নিউজ : কতক্ষণ লাগল উদ্ধার করতে?

রেশমা : ঠিক মনে নেই। তখন কোনো সময়ের ধারণা ছিল না। শরীরও চলছিল না।

জাগো নিউজ : দেয়াল ভাঙল না কাটল?

রেশমা : কেটে বের করলেন। উদ্ধারকারীরা একটি লাইট দিয়ে আমাকে সরে যেতে বলেন। আমি সরে গিয়ে শুয়ে ছিলাম।

জাগো নিউজ : এরপর?

রেশমা : মেজর মোয়াজ্জেম স্যার ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে বের করলেন। সেখান থেকে আমাকে সিএমএইচে নেয়া হয়।

জাগো নিউজ : ১৭ দিন অন্ধকারে আটকা। অনাহারে। বাঁচবেন না মরবেন কোনটি বেশি ভাবছিলেন?

রেশমা : শেষের দিকে আর মনে হয়নি যে, আমি সেখান থেকে আর বের হতে পারব। আমাকে কেউ আর উদ্ধার করতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছিল। আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেলাম।

অনেক কিছুই ভেবেছি অন্ধকারে বসে বসে।

জাগো নিউজ : আপনাকে উদ্ধার করা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন এটি নাটক ছিল। এর জবাবে কী বলবেন?

রেশমা : তাদের প্রশ্নের জবাবে আমি কিছু বলতে চাই না। আমি কোথায় আটকা ছিলাম, তা তো তারা দেখেনি। আমাকে উদ্ধার করাও সবাই দেখেনি।

কী অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তা তারা দেখতে পায়নি বলেই এমন প্রশ্ন করেন। আমার সামনেও অনেকে বলেন। জবাবে কিছু বলি না।

জাগো নিউজ : কাছে মোবাইল ছিল না?

রেশমা : না। আমি কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতাম না।

জাগো নিউজ : ঢাকায় এসেছিলেন কবে?

রেশমা : ২০১০ সালে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে হেমায়েতপুরে বড় বোনের বাসায় ছিলাম। বোন এখনও গার্মেন্টসে চাকরি করেন।

জাগো নিউজ : স্কুলে গিয়েছিলেন?

রেশমা : ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ে আর স্কুলে যাইনি।

জাগো নিউজ : বাবার মৃত্যু হয়েছিল কবে?

রেশমা : বাবার মৃত্যুর কথা মনে নেই। আমরা তিন বোন, দুই ভাই। আমি সবার ছোট। বড় ভাই এবং মা দিনাজপুরে থাকেন। আর সবাই এখন ঢাকায় থাকেন।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি