অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইতোমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনের নামে সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য, সরকার কর্তৃক অবৈধ সিটিং সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা, পরবর্তীতে ফের চালুসহ নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যে এখন সময়ের দাবি- এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় পরিবহন এ বিশেষজ্ঞের। ৩ পর্বের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ : সিটিং সার্ভিস নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। আপনি এটিকে কিভাবে দেখছেন?
ড. সামছুল হক : অবশ্যই মানুষের সিটিং সার্ভিসে চাহিদা আছে। কিন্তু মাঝপথের যাত্রীদের কী হবে? সবাই-তো সিটিং সার্ভিসেই যাচ্ছে। মাঝপথের যাত্রীদের জন্য কোনো সেবা থাকবে না?
এখানেই পেশাদারিত্বের প্রশ্ন। বিশৃঙ্খল পরিকল্পনায় পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে না।
Advertisement
জাগো নিউজ : সিটিং সার্ভিস বন্ধে সরকারের পিছুটান লক্ষ্য করা গেছে। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
ড. সামছুল হক : এমন আত্মসমর্পণ আগেও হয়েছে। সম্প্রতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের দিন সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল চালকরা। তারা মনে করল, তাদের পেটে লাথি মারা হলো। চালক সাড়ে ছয় হাজার। তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তারা আবার রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধও নয়।
এত সংখ্যক চালককে তো ম্যানেজ করার উপায় থাকে না। সরকার অব্যবস্থাপনাকে ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। এটি চিন্তা করাই তো বোকামি। যে সিস্টেমের জন্ম পঙ্গুত্বের মধ্য দিয়ে, তাকে আপনি সুস্থ করবেন কিভাবে?
জাগো নিউজ : পঙ্গু এ সিস্টেম নিয়ে আমরা আসলে যাচ্ছি কোথায়?
Advertisement
ড. সামছুল হক : ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে হলে আপনাকে পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করতে হবে। আজ থেকে ২০ বছর আগে রাজধানীতে প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিবেগ ছিল ২৫ কিলোমিটার। পাঁচ বছর পর হলো ঘণ্টায় ১৮ কিলোমিটার। ১৯৯৪ সালে ডিআইটিএস (ঢাকা সমন্বিত যানবাহন সমীক্ষা) প্রথম এ গতি নিয়ে রিপোর্ট করে। ১৯৯৮ সালে রিপোর্ট উপস্থাপন করে সংস্থাটি। এখন রিভাইসড এসটিপি (কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা) রিপোর্ট বলছে, রাজধানীতে ঘণ্টায় গড় গতি হচ্ছে ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার।
একটি নগরী স্থবির হয়ে পড়লে, তার কোনো স্পন্দন থাকে না। স্পন্দন না থাকলে তাকে মৃতনগরী বলা হয়। মুখের কথা নয়। এটি বিজ্ঞানের কথা।
জাগো নিউজ : এ গতিহীনতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব কিসের উপর পড়ছে?
ড. সামছুল হক : গণপরিবহন। স্টাডিতেও তাই এসেছে। গতি স্তিমিত হয়ে পড়লে ব্যাপক হারে কেবল প্রাইভেট বা সিএনজি গাড়িই বাড়তে থাকবে। মোটরসাইকেল বাড়বে। উন্নত বিশ্ব জানে বাসকে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটারে চালাতে হবে। অনেক শহরে তাই চলে। সবাই যানজটে পড়ে থাকলেও বাসের লেন পরিষ্কার থাকে। সে তার নিজস্ব গতি নিয়ে নির্বিঘ্নে যেতে পারছে।
জাগো নিউজ : সরকার যানজট নিরসনে নানা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রাস্তা, ফ্লাইওভার করছে…
ড. সামছুল হক : সোজা, সস্তা আর ভোটের রাজনীতির জন্যই এখন উন্নয়ন হয়। এ উন্নয়নে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। এসটিপিতে প্রথমেই বলা ছিল বাসকে সুশৃঙ্খল কর। ফুটপাত পরিষ্কার কর। এ জন্য খরচ লাগে না। ইচ্ছা থাকলে আজই করা যায়। কিন্তু হবে না। কারণ এখানে রাজনীতি আছে।
সরকারও হোয়াইট কালার জবে বিশ্বাসী। ফ্লাইওভার উদ্বোধন করতে ফিতা কাটা যায়। ফুটপাত দখলমুক্ত করে বা গণপরিবহনের সেবা বাড়িয়ে ফিতা কাটা যায় না। এখানে ঘাম ঝরে। সবই সিন্ডিকেটের অংশ। আগে ডিপার্টমেন্টগুলো মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করত। এখন আর তা নেই। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে দেখুন, কী সর্বনাশ করা হয়েছে! কোনোই জবাবদিহিতা নেই।
জাগো নিউজ : তাহলে উন্নয়নের মানে কী দাঁড়ায়?
ড. সামছুল হক : আমি এ উন্নয়ন ডিকটেটেড উন্নয়ন বলি। যার অর্থ নির্দেশিত বা স্বেচ্ছাচারী উন্নয়ন। তথ্য নেই, পরিকল্পনা নেই। ফ্লাইওভার একটিতে কাজ হচ্ছে না, তাহলে আরেকটি কর। প্রয়োজনে ফ্লাইওভার দিয়ে গোটা নগর ঢেকে দাও। পরিবহন এমন একটি জটিল বিষয়, যার পরিকল্পনা ২৫ বছর আগে নিয়ে রাখতে হয়।
জাগো নিউজ : এরপরও নগরে থাকতে হচ্ছে। এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠার কোনো উপায় আছে কি?
ড. সামছুল হক : ২০০৫ সালে রেল, নৌ ও সড়কপথ নিয়ে সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হলো। বাসগুলো একত্রিত করার কথা বলা হলো। বলা হলো, বাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লেনে ছেড়ে দাও। এরপর মেট্রোতে যাও। উপরে দুটি এমআরটি (মাস র্যা পিড ট্রানজিট), নিচে একটি বিআরটি (বাস র্যা পিড ট্রানজিট) করো।
জাগো নিউজ : সরকার তো এমআরটি ও বিআরটিতে যাচ্ছে…
ড. সামছুল হক : বিআরটি হবে না। ফ্লাইওভার হয়ে গেছে। অমিত সম্ভাবনাগুলো কবর দেয়া হয়েছে। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ছিল না। সেখানে চারটি এমআরটি এবং দুটি বিআরটি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আর একটিও হবে না। সরকার বিআরটি-৩-এর কথা বলছে। মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে সেটাও আর হবে না।
সবক্ষেত্র নষ্ট করে এখন পেছাতে পেছাতে উত্তরার দিকে যাচ্ছে সরকার। অযৌক্তিক উন্নয়নই এখন সর্বনাশের মূল কারণ। কথিত উন্নয়ন কী ক্ষতি করছে, তা দুটি প্রকল্প আমলে নিলেই পরিষ্কার হয়। তিনটি এমআরটি এবং দুটি বিআরটি সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ৩১টি জেলা থেকে মানুষ এসে কেউ বাসে, কেউ মেট্রোতে, কেউ বিআরটিতে আবার কেউ সিএনজি অথবা রিকশায় করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে পারত। এক মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারই সব শেষ করে দিয়েছে।
এ সর্বনাশ বিশ্লেষণ না করে আবার মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারে গেল। ন্যাড়া নাকি একবার বেলতলায় যায়। আর আমাদের সরকার গেল দু’বার। বিআরটি-৩ বনানী আসার কথা ছিল। তাও আর হচ্ছে না।
জাগো নিউজ : এখন কোথায় ঠেকবে?
ড. সামছুল হক : এখন আর এটি হচ্ছে না। এর বর্ধিত অংশ হচ্ছে অর্থাৎ মূল অংশ হচ্ছে না। গাজীপুর থেকে এসে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ঠেকবে।
জাগো নিউজ : এয়ারপোর্ট থেকে মানুষ যাবে কীভাবে?
ড. সামছুল হক : একই প্রশ্ন আমিও সরকারকে করেছিলাম। জবাব নেই। ২০১০ সালে নেয়া হয়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত একটি করিডর। তা আর হলো না। এখন সরকার বিআরটি-৩ মহাখালী পর্যন্ত আনার জোড়াতালির পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানতে পারলাম। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে অযৌক্তিক ফ্লাইওভারের কারণে, তা আর কোনো দিনই পূরণ হবার নয়।
ফ্লাইওভারের কারণে ফুটপাত সংকীর্ণ হয়ে গেল। মূল সড়কে খুঁটি বসল। চাইলেও আর মেট্রো বা বিআরটি করা সম্ভব হবে না। অপেশাদার জনবলই আত্মঘাতী উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। খাম্বা বা দৃশ্যমান খুঁটিই তাদের কাছে উন্নয়নের দর্শন।
জাগো নিউজ : তাহলে কি এ ফাঁদ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই?
ড. সামছুল হক : মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে যান। কোনো ড্রেনেজ সিস্টেম পাবেন না। যারা এটি তৈরি করেছেন, তারা জানেন এটি উজবুকের জাতি।
সরকারে সজ্ঞানের কোনো লোক আদৌ আছে কিনা- আমার জানা নেই। থাকলে ফ্লাইওভারের নিচে লাখ লাখ মানুষকে এভাবে জিম্মি করে রাখার কথা নয়। অথচ এ আমজনতাকে দেখিয়ে প্রজেক্ট নেয়া হয়, বিনিয়োগ করা হয়।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি