বিশেষ প্রতিবেদন

কাজ থেকে মুক্তি নেই যাদের

তপ্ত রোদে কারওয়ান বাজার এলাকার একটি ফুটপাতে বসে কুড়িয়ে আনা প্লাস্টিকের ব্যাগ পরিষ্কার করছিলেন বয়োবৃদ্ধ আছিয়া বেগম। এ প্রতিবেদকের কৌতূহলী আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তিনি বলে উঠলেন, ‘সারা দিনে খুঁটে এনে আজ এগুলো পেয়েছি। পরিষ্কারের পরে বিক্রি করব।’

Advertisement

কথা আরও এগিয়ে যায়। প্রশ্নোত্তরে তিনি জানালেন, এভাবে কোনোদিন ৫০ টাকা, কোনোদিন ১০০ টাকাও আয় হয়।

কথার ফাঁকে সন্তানদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় আছিয়া বেগমের কাছে। এবার মুখটা ফ্যাকাশে করে বললেন, ‘আছে সবাই নিজেদের মতো করে। নিজেরাই সংসার চালাতে হিমশিম খায়। বাবা-মা তাদের ওপর বাড়তি বোঝা। তাই আমরা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই নিজেদের চালাই। লালমনিরহাট থেকে ঢাকা এসে আমার স্বামী রিকশা চালায়। আর আমি কাগজ কুড়াই। থাকি ফুটপাতে। দু’জনের আয় দিয়েও বাঁচা অনেক কঠিন।’

আছিয়া বেগম নিজের বয়স জানেন না। তবে চেহারা দেখে যতটা আন্দাজ করা যায়, সত্তর ছাড়িয়েছেন। এ বয়সেও দিনভর তিনি কাগজ কুড়িয়ে বেড়ান। অন্য কাজ পেলে সেটাও করেন।

Advertisement

সন্তানরা ভুলে গেলেও তিনি ভুলতে পারেন না। তাই জমানো টাকা থেকে নাতি-নাতনিদের জন্য উপহারও কিনে পাঠান আছিয়া।

জাগো নিউজকে বলেন, ‘বয়স বেড়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের চাহিদাও বেড়েছে। তাই কাজ থেকে মাফ নেই।’

বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও সন্তানদের বঞ্চনা, সংসারের অভাব আর জীবন বাঁচানোর তাগিদে শ্রমের বোঝা টানতে হয় আছিয়া বেগমের মতো বহু বয়োবৃদ্ধকে।

আছিয়া বেগমের সঙ্গে আলাপ সেরে এগিয়ে আসতেই কারওয়ান বাজারের আরেক প্রান্তে বসে থাকতে দেখা গেল আরও এক বয়োবৃদ্ধকে। ভিখারি ভেবে টাকা এগিয়ে দিতেই বললেন, ‘টাকা চাই না, একটা কাজ দেন।’

Advertisement

যে ঢাকা শহরে সুস্থ-সবল মানুষের ভিক্ষা করাটা আমাদের কাছে সহনীয় হয়ে গেছে, সেখানে প্রায় সত্তরোর্ধ্ব এক নারীর কাজ চাওয়াটা কানে লাগল বৈকি! এবার কৌতুহলবশত তার সঙ্গে আলাপ জমানো।

একটি বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে নাম জানালেন, রহিমা বিবি। কিশোরগঞ্জের বালিয়াঘাটা থেকে কয়েক দিন আগে ঢাকা এসেছেন কাজের খোঁজে। বহু বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে দু’ছেলেকে বড় করলেও তাদের ঘরে বৌ আসার পর সংসারে ঠাঁই হয়নি তার। তবু ভিটে আঁকড়ে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে দিন চলে যাচ্ছিল।

রহিমা জানান, সেটাও কপালে সইল না। সর্বনাশা বন্যায় এলাকা ডুবে গেছে। এখন কারও বাড়িতেই কাজ নেই। এদিকে, শরীরটাও খারাপ হয়ে গেছে। তাই ছেলেদের ওপর বোঝা না হয়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসা।

জীবিকার পাশাপাশি শরীরের চিকিৎসাও করাতে চান রহিমা বিবি। তবে গত কয়েক দিন অনেকের দ্বারে গেলেও কোনও কাজ পাননি।

ভাঙা শরীর নিয়ে কাজ করতে চাইছেন কেন- জানতে চাইলে বলেন, ‘হাত পেতে ভিক্ষা নিতে লজ্জা করে। তাই কাজ চাই। কিন্তু বয়স দেখে কেউ কাজ দিতে চায় না। এছাড়া ভারি কাজ করার ক্ষমতাও আমার নেই।’

বয়স্ক নাগরিকদের জন্য সরকারের উদ্যোগের অভাব আর সন্তানদের অবহেলার কারণে শেষ বয়সেও দেশের লাখ লাখ প্রবীণ বাধ্য হয়ে কঠিন কাজ করছেন বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী সালমা আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রবীণদের পুনর্বাসনে সরকারি উদ্যোগ নেই বললেই চলে। সম্প্রতি বাবা-মায়ের ভরণপোষণ দেয়া নিয়ে আইন করা হলেও এর প্রয়োগ নেই। আবার অনেক বাবা-মা সন্তানের অভাবের সংসারে বোঝা হতে না চেয়ে নিজেরাই কাজে নেমে পড়েন।’

‘এ অবস্থায় রাষ্ট্রকেই এসব ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে হবে’- বলেন তিনি।

জেপি/এমএআর/বিএ