কাকডাকা ভোর থেকেই কোদাল, খুন্তি, বিড়া, ডালাসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে আছেন অনেকে। চোখে-মুখে একরাশ শূন্যতা। এই বুঝি ডাক পড়বে, হয়তো আজকের মতো প্রিয়জনের মুখে দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা হবে। রাজধানীর নিউমার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের শেকেরটেক, আদাবর, ভাটারা, গাবতলী, আমিনবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন শ্রমবাজারের হাট বসে। এসব বাজারের পণ্য হলেন দিনমজুর, শ্রমিক। দেখেশুনে তরতাজা আর শক্তিমান হলে দাম বেশি। আর বয়স্কদের দাম কম। এভাবেই রাজধানীতে এখনও ‘দাসপ্রথা’ চালু আছে। তবে তা আধুনিক মোড়কে। কিন্তু সারাদিনের জন্য কাজ করে কত পান তারা? সেটা কি শ্রমের তুলনায় যথেষ্ট? আর কাজ না পেলে কী করেন তারা? কেনইবা এ পেশা বেছে নিয়েছেন এই হতভাগারা? গ্রাম ছেড়ে কেনইবা তারা শহরমুখী হয়েছেন। এমন নানা বিষয় জানতে কথা হয় বাজারে ওঠা এসব শ্রমজীবীর সঙ্গে।অনেকটা দুঃখ আর অসহায়ত্বের গল্প শোনান তারা। এখন বাজারে অনেক মৌসুমি শ্রমিক। তাই চাহিদা কমে গেছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দামতো কখনও কমে না। এছাড়া বয়স্কদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাতে চান না। অথচ পেট তো সবারই চালাতে হয়। বছরখানেক আগে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরিতে কাজ করলেও এখন বাজার খুবই মন্দা। কখনও কাজ মেলে আবার কখনও মেলে না। কাজ মিললেও দৈনিক ১৫০ টাকা দেয়া হয়। এখানেও আছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। দালালদের দিতে হয় মজুরির একটা অংশ। কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে আসা আবদুস সালাম মহাখালী রেলগেটে বসেছিলেন। জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে এগিয়ে আসতে দেখে তিনিও এগিয়ে এলেন। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় শুনে কিছুটা হতাশ। কারণ তখন সকাল প্রায় ৮টা। হতাশ কেন- জানতে চাইলে আবদুস সালাম বলেন, বেলা তো কম হলো না। হিসাবি গৃহকর্তারা ৭টার মধ্যেই এসে তাদের নিয়ে যান। বেলা যত বাড়ছে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা তত কমছে।৪৫ বছর বয়সী ভগ্ন স্বাস্থ্যের আবদুস সালামের খেদোক্তি, ‘আমগোরে এমনিতেই কেউ নিবার চায় না। কারণ আমরা বুইড়া। তাই বাড়িঘর পরিষ্কার করার কাম করি। কিন্তু তাও পাই না। কিন্তু পেট তো আর মানে না।’তিনি বলেন, ‘নদীভাঙনের কবলে পড়ে প্রায় এক বছর আগে ঢাকায় আসি। সেই থেকে অর্ধাহারে- অনাহারে দিন কাটছে। পরিবারে তিনি ছাড়াও স্ত্রী আছে। আর তিন ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। তাদের সংসারেও টানাটানি, এ কারণে বাপ-মায়ের খোঁজ নেয় না কেউ।’ শুধু পুরুষ নয়, কাজের জন্য নারীদেরও এসব বাজারে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তাদের একজন আমেনা। তিনি বলেন, ‘মাইয়া মানুষ হওয়ায় কেউ কাম দেবার চায় না। কাম দিলেও মজুরি কম দেয়।’তিনি আরও বলেন, ‘কাজ না পেয়ে ভিক্ষা করারও উপায় নেই। কারণ মানুষ কয়, সুস্থ মানুষ হইয়া তুমি ভিক্ষা কর ক্যান? কাজ পাইলেও মজুরির ভাগ দিতে হয় দালালগো।’জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন চলে ধামরাইয়ের ৮০ বছর বয়সী মো. আব্দুল হকের। গায়ের জোর দেখিয়ে অন্যরা কাজ পেলেও তার সে অবস্থা নেই। গত ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করে পরিবার চালাতেন। বর্তমানে কেউ কাজে নিতে চান না। অক্ষমতার কারণে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। অসহায় এ দিনমজুর বয়সের কাছে হারতে নারাজ। তাই প্রতিদিন ভোরে শহরের বিভিন্ন স্থানে কাজের অপেক্ষায় বসে থাকেন।আব্দুল হক বলেন, ‘বয়স বেশি হইছে, হেয় লাইগা কেউ আমারে কামে নিতে চায় না। কি করমু, পেটে তো দিতে হয়, তাই কামের লাইগা বইসা থাকি। কারও দয়া হইলে কাম দেয়। হেই দিয়া চইলা যায়।’ ‘হুনছি সরকার নাকি বুইড়াদের টাহা দেয়, আমার আর কতো বয়স হইলে হেইডা পামু’- প্রশ্ন রাখেন তিনি। মধ্য বাড্ডায় শ্রমিক কিনতে আসেন আবুল মোমেন। শক্ত ও সামর্থ্য অনেককে কাছে ডেকে কথা বলছিলেন। তার বাড়িতে পাঁচজন নির্মাণ শ্রমিক দরকার। জাগো নিউজকে তিনি জানান, কাজ করতে পারবে এমন লোকই তো সবাই চায়। এতে দোষের কিছু নেই। বরং সরকার বয়স্ক, অক্ষম ও নারীদের জন্য বিশেষ সাহায্য দিতে পারে। দিনমজুর সরবরাহকারী কন্ট্রাক্টর মনিরুল ইসলাম জানান, মজুরদের আগের মতো কাজে নেয়ার সুযোগ পাই না। কম টাকা মজুরিতে কেউ যেতেও চান না। বছর খানেক আগে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা দিয়ে কাজ করালেও এখন বাজার খুবই মন্দা। ফলে দৈনিক ১৫০ টাকা হারে শ্রমিকদের কাজে যেতে হয়।এইচএস/এমএইচএম/এমএআর/বিএ
Advertisement