দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ২০তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কী আজ (৩০ এপ্রিল)। ১৯৯৮ সালের এই দিনে আইপিজিএমআর থেকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পথচলা শুরু করে বিএসএমএমইউ। কালের পরিক্রমায় গত ১৯ বছরে একাধারে চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও গবেষণায় স্বাস্থ্য খাতে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠছে এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
Advertisement
বিএসএমএমইউ’র ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বের যেকোনো দেশের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে একাধারে চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও গবেষণায় সফলতা অর্জন করতে হয়। বিএসএমএমইউকে আন্তর্জাতিক মানের সেই ধরনের একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে গত দুই বছর ধরে প্রশাসনের সবাই মিলে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে শিক্ষা ও গবেষণায় সাফল্যের কারণে স্পেনের সিমাগো রিসার্চ গ্রুপ পরিচালিত জরিপে বিশ্ব সেরার তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ৬৪০তম স্থান অর্জন করেছে। শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও গবেষণায় গতিশীল নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অ্যাডুকেশন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসানের নেতৃত্বে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে প্রশাসন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা ও নার্সদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করছেন। মতবিনিময়ে ‘রোগীর দায়িত্ব চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই নিতে হবে, যাতে রোগীর স্বজনরা রোগীকে হাসপাতালে রেখে নিরাপত্তা বোধ করে’ তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
Advertisement
বর্তমানে বিএসএমএমইউ’র ১ হাজার ৯০৪ শয্যার হাসপাতালে রোগীদের প্রায় সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ নার্স, ওয়ার্ডবয় ও কর্মচারীরা রোগীর শয্যা পাশে দিবারাত্রী হাসিমুখে ডিউটি করছেন। হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ সহস্রাধিক ও বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া এমআর ও সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তুলনামূলক কম খরচে করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসাসেবার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমান প্রশাসন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা ও সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করছেন। রোগীদের সুবিধার্থে কেবিন ব্লকে জরুরি বিভাগ চালুর কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে কেবিন ব্লকে সর্বাধুনিক ৩৭ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ ও এইচডিইউর পাশাপাশি নবজাতকদের জন্য ৩১ শয্যাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক এনআইসিইউ চালু রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় করোনারি এনজিওপ্লাস্টির সুব্যবস্থা ও ডে কেয়ার ওটি এবং প্রবীণদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য জেরিয়াট্রিক মেডিসিন উইং চালু করা হয়েছে।
এছাড়া বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ল্যাব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, শিশু কিডনি বিভাগে অত্যাধুনিক আলট্রাসনোগ্রাফি ও রেনাল বায়োপসি মেশিন চালু, ২৪টি বিভাগে বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোর সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আউটডোরে গত বছর সেবা নিয়েছেন সাড়ে ১১ লাখ রোগী এবং ২০১৫ সালে ১১ লাখ ৬০ হাজার রোগী আউটডোর থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া বৈকালিক স্পেশালাইজড সার্ভিস থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৫১৭ জন রোগী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সুচিকিৎসার জন্য প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা সেল গঠন, পুরনো টিনশেড আউটডোরে ১৮ শয্যাবিশিষ্ট রিহ্যাবিলিটেশন মেডিসিন ওয়ার্ড চালু, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগীদের সুবিধার্থে অ্যাফেরেসিস সার্ভিস চালু, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের জন্য প্যানেল রিঅ্যাক্টিভ অ্যান্টিবডি (পিআরএ) পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এইচএলএ টিস্যু টাইপিং ল্যাবরেটরি উদ্বোধন, রিউমাটোলজি স্পেশালাইজড ক্লিনিক চালু, বহির্বিভাগে সমন্বিত সেবা সম্বলিত থ্যালাসেমিয়া সেন্টার চালু, হেমাটোলজি স্পেশালাইজড ল্যাব উদ্বোধন, প্যাথলজি বিভাগে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ে সাইটোলজি পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।
Advertisement
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৯১টি পোস্ট গ্রাজুয়েট বিষয় (এমডি-৩৪টি, এমএস-২২টি, এমপিএইচ-৮টি, এমফিল-১১টি, ডিপ্লোমা-১৪টি উল্লেখযোগ্য) চালু রয়েছে। নতুন নতুন বিষয় যেমন- প্যাডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি, প্যালিয়েটিভ মেডিসন, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট মেন্টাল হেলথ ও প্যাডিয়াট্রিক নিউরোলজি অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক এমডি রেসিডেন্সি কোর্স খোলা হয়েছে। বিএসএমএমইউতে প্রথমবারের মতো এমএসসি ইন নার্সিং কোর্স চালু করা হয়েছে।
এছাড়া অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, ইনস্টিটিউশনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৪২টি উন্নীত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তনও (টিএসসি) চালু করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত মাসিক সেমিনারের আয়োজন, সান্ধ্যকালীন শিক্ষা ও সেবা কার্যক্রম চালু ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, দায়িত্বশীলতা ও নৈতিক বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছে।
ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভর্তি পরীক্ষা কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই অত্যন্ত সুষ্ঠু, সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে যথাযথ নিয়মে সম্পন্ন হচ্ছে। এছাড়া দ্রুত ফল প্রকাশ বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার সম্পন্ন হওয়ার দিনই তা প্রকাশের ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত পাঁচ বছরে (২০১১-১৬ সালের অক্টোবর) মোট ১৪৪৭টি গবেষণা কর্ম সম্পন্ন হয়েছে। তন্মধ্যে গত দুই বছরে ৭৪৩টি গবেষণা কর্ম সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে রিচার্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড প্রোমোশন সেল গঠন করা হয়েছে।
এ সময়ে মোট ১০৮ জন শিক্ষক ও ৫১২ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ৬২০ জনকে গবেষণা মঞ্জুরি ও থিসিস গ্রান্ট প্রদান করা হয়। এছাড়া অসংক্রামক রোগ (নন-কমিউনিকেবল ডিজিস) গবেষণায় আঞ্চলিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়।
ভিসি জানান, গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে শিকাগো ইউনিভার্সিটি, কানাডার নভেল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিএমএইচ, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান।
এমইউ/আরএস/আরআইপি