নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিশাল জাহাজের চর। উপজেলার ৩ ইউনিয়ন জুড়ে গড়ে উঠা প্রায় ৮০টি জাহাজ কারখানা এখন হাজার মানুষের পদচারণায় এক কর্মমুখর জনপদ। কাটিং জাহাজের শিটে এ অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে বালুর ছোট বাল্কহেড থেকে শুরু করে কার্গো জাহাজ ও যাত্রীবাহী বিশাল সব লঞ্চ ও ফেরী। পাল্টে গেছে এলাকার রুপরেখা ও অর্থনৈতিক চিত্র। এ শিল্প থেকে সুবিধা গ্রহণ করছে স্থানীয় ৫০ হাজার মানুষ। তবুও সঠিক পৃষ্টপোষকতার অভাবে রফতানিযোগ্য জাহাজ তৈরিতে এখনো অদক্ষতার পরিচয়ে আছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সরকারি দফতরের বিড়ম্বনা ও হয়রানির ঘটনা। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ডেমরা থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে উত্তরে কালো অজগরের মতো এঁকেবেঁকে গেছে পীচঢালা সড়ক। সেই রাস্তা ধরে মাত্র ৩ কিলোমিটার এগুলোই জাহাজ তৈরির অসংখ্য কারখানার দেখা মিলবে। কোনটি নতুন তৈরি হচ্ছে অথবা কোনটি সমাপ্তির পথে। যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যাবে বড় বড় জাহাজ দেখে। শীতলক্ষ্যা পাড় এখন এলাকাবাসীর কাছে জাহাজের চর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আর এ জাহাজের গ্রাম রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া। এছাড়া স্থানীয় মুড়াপাড়া ও তারাব পৌরাঞ্চলের শীতলক্ষ্যার পাড়ে গড়ে উঠেছে আরো ছোট বড় অসংখ্য জাহাজ কারখানা। অজোঁপাড়াগাঁ বলতে যা বোঝাই তাই ছিল কায়েতপাড়া গ্রামটি। অথচ সময়ের ব্যবধানে সেখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জাহাজ তৈরির শিল্প। হাজার মানুষের পদচারণায় কায়েতপাড়া এখন এক কর্মমুখর জনপদ। কায়েতপাড়ার পূর্বগ্রাম, ভাওয়ালীয়াপাড়া, ডাক্তারখালী, বড়ালু, মাঝিনা, হড়িনা, ও ইছাখালীর চরে রয়েছে প্রায় ৬০টি জাহাজ তৈরির কারখানা। এছাড়া উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নের গঙ্গানগর ও দড়িকান্দির চরে রয়েছে আরো ৮/১০টি প্রতিষ্ঠান। আর তারা পৌরসভার রুপসী ও গন্ধবপুর এলাকার আরো ১০/১২টি প্রতিষ্টান। মাস্টাং ডকইয়ার্ড, খান ডকইয়ার্ড, ফাহিম ডকইয়ার্ড, শামস ডকইয়ার্ড, তালহা ডকইয়ার্ড, আমির ডকইয়ার্ড, মালেক ডকইয়ার্ড, ফটিক ডকইয়ার্ড, ভাই ভাই ডকইয়ার্ড, মনির ডকইয়ার্ড, মাস্টাং ইঞ্জিনিয়ারিং কায়েতপাড়ার জাহাজ কারখানাগুলোর অন্যতম। সম্পৃক্ততা যাদের : জাহাজ মালিকদের ইতিহাস প্রাচীন। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৭৯৯ সালে ব্রিটেন দ্বিতীয় যুদ্ধজোট গঠনের পর জোট থেকে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে একটি বার্তা আসে মিত্র হিসেবে ভারতবর্ষ থেকে জাহাজ তৈরির জন্য কিছু শ্রমিক প্রেরণ করার। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) থেকে ৩২০ জন শ্রমিক ব্রিটেনে পাঠান। শোনা যায় তারা বর্তমান ঢাকার দোহারের অধিবাসী ছিলেন। সেই থেকে জাহাজ তৈরি দোহারবাসীর আদি ব্যবসা। কাঠের জাহাজের প্রচলন না থাকলেও বাংলাদেশে যারা জাহাজ তৈরি করেন বা জাহাজের ব্যবসা করেন তাদের অধিকাংশের বাড়ি ঢাকার দোহারে। আবার অনেকে মজা করে বলেন বাড়ি আমার দোহার, কাজ করি লোহার। অন্যদিকে যারা জাহাজ তৈরির কারিগর তাদের বাড়ি দোহার, বিক্রমপুর, পিরোজপুর, রাজবাড়ির গোয়ালন্দ আর নবাবগঞ্জে। রং এবং রাজমিস্ত্রির কাজ করেন স্থানীয়রা। জাহাজ তৈরির জন্য যিনি জমি দেন এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন তাকে বলা হয় কারখানার মালিক। আর যারা জাহাজটি ফিটিংস করেন তাদের বলা হয় ফিটার। জাহাজে ঝালাইয়ের কাজ করেন ওয়েল্ডার আর পুরো ব্যাপারটা যে নিয়ন্ত্রণ করে সে হলো ঠিকাদার। জাহাজ তৈরির সকল উপকরণ কিনে দেন জাহাজ মালিক। জমির মালিক একটি জাহাজ ফেলার জন্য জমির ভাড়া নেন ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। একজন ঠিকাদারের মাসিক বেতন ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। একজন রাজমিস্ত্রি দৈনিক হাজিরা পান ৪০০ টাকা তার সহযোগী ৩০০ টাকা। ফিটারের দৈনিক বেতন ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওয়েল্ডার পায় ৩০০ থেকে ৪৫০টাকা মধ্যে। রং মিস্ত্রির হাজিরা ৩৫০ টাকা তাদের সহকারীদের বেতন ২৫০ টাকা। আর সকল হেলপারদের দৈনিক হাজিরা ২০০ থেকে আড়াইশ টাকার মধ্যে। সকল খরচ শেষে একটি জাহাজ পানিতে নামানোর পর জাহাজ মালিক আলোচনার ভিত্তিতে তা বিক্রি করেন। বছরে ৪০/৫০ লাখ টাকার মতো তাদের আয় হয় বলে জানা যায়। এ ছাড়া অত্র এলাকায় শিল্পটি গড়ে উঠায় এলাকাতে বাড়ি ভাড়া, গর্দার ব্যবসা, লেদ মিশেন, খুচরো যন্ত্রাংশ আর পান/সিগারেটের দোকান দিয়ে এলাকার মানুষ বাড়তি উপার্জন করছে। সর্বসাকুল্যে উপজেলার জাহাজ শিল্পর সাথে জড়িত প্রায় ৫০ হাজার লোক সুবিধা ভোগ করছে এ শিল্প থেকে।এছাড়া পূর্বপাড়ের সিটি ডকইয়ার্ড এখানকার অন্যতম বড় কারখানাগুলোর একটি। আড়াই’শ ফিট থেকে শুরু করে শত ফিটের কোষ্টার বা মালবাহী জাহাজ, সরোঙ্গা, ফেরী, জেটি, পল্টন, বালুবাহী ট্রলার, ব্লাকহেট আর ড্রেজার তৈরি হয় শীতলক্ষ্যার এই চরে। তৈরি হচ্ছে অর্ধশত কোটি টাকা মূল্যর বিশাল যাত্রীবাহী লঞ্চও।## রূপগঞ্জে যেভাবে তৈরি হয় জাহাজএআরএস/পিআর
Advertisement