জাতীয়

আবার দখল ধানমণ্ডি মাঠ

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব মাঠে সাধারণ মানুষের প্রবেশে আবারও বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘ধানমণ্ডি মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত’ লেখাসংবলিত সাইনবোর্ডটিও সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এলাকাবাসী ও পরিবেশকর্মীদের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ওই সাইনবোর্ড লাগিয়েছিল ডিএসসিসি।স্থানীয় অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, মাঠে প্রবেশ করার ফটকটি বন্ধ করে একটি পকেট গেট খুলে রাখা হয়েছে। সেখানে ক্লাব কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা সাধারণ মানুষকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন। আর মাঠের সব স্থানে পুঁতে রাখা হয়েছে ছোট ছোট খুঁটি। মাঠে দীর্ঘ সময় মানুষের প্রবেশ বন্ধ থাকায় আগাছা জন্মেছে প্রচুর।জানা গেছে, নিরাপত্তা আর স্থাপনা নির্মাণের অজুহাতে আবারও কেড়ে নেওয়া হলো ধানমণ্ডি মাঠে সাধারণের প্রবেশাধিকার। দীর্ঘ আন্দোলনের পর মাঠে ঢোকার অধিকার ফিরে পেয়েও এখন আবার বঞ্চিত ধানমণ্ডি, কলাবাগান, শুক্রাবাদসহ আশপাশের এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী। তবে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, জনগণের মাঠ যেকোনো মূল্যে উন্মুক্তই থাকবে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) খালিদ হোসাইন গত বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে ধানমণ্ডি মাঠে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়নি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও মাঠের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। এ মাঠ নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ার পর আমরা গেট খুলে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আবারও কোনো জটিলতা তৈরি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মাঠের প্রবেশপথে ক্লাবের নিয়োজিত দুজন নিরাপত্তাকর্মী দাঁড়িয়ে আছেন। মাঠের ভেতরে ঢুকতে চাইলে তাঁদের বাধার মুখে পড়তে হয়। মাঠে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে কি না জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী জলিল বলেন, ‘মাঠে প্রবেশ করা যাবে না। ক্লাব কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে।’ ডিএসসিসির ঝোলানো সাইনবোর্ড নেই কেন জানতে চাইলে জলিল বলেন, ‘গত রোজার ঈদের আগেই কে বা কারা সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলেছে।’ নিরাপত্তাকর্মীদের বুঝিয়ে মাঠে ঢুকে দেখা যায় সারা মাঠে ছোট ছোট খুঁটি পুঁতে রাখা। মাঠে ঘাসগুলো বড় হয়ে অনেকটা পরিত্যক্ত ঝোপের মতো দেখাচ্ছে। মাঠের পূর্ব পাশে বেশ কিছু অংশ জাল দিয়ে ঢেকে রাখা।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধানমণ্ডি শেখ জামাল ক্লাবের সভাপতি মঞ্জুর কাদের বলেন, ‘ধানমণ্ডি মাঠটি সরকারি সম্পত্তি। এ মাঠ নিয়ে কিছু পরিবেশবাদী মামলা করেছে। আদালতে মামলা থাকায় এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না।’গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মাঠের প্রবেশপথে বসে কথা বলছিল দুই বন্ধু রাশেদ চৌধুরী ও সিয়াম আহমেদ। মাঠের ব্যাপারে জানতে চাইলে কলাবাগানের বাসিন্দা ১৫ বছর বয়সী রাশেদ চৌধুরী বলে, ‘অনেক আন্দোলন করে আমরা মাঠে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এলাকার সবাই এখানে সকাল-বিকেল আসত। এখন কেউ আসে না। কারণ এলেও মাঠে প্রবেশ করতে দেয় না নিরাপত্তাকর্মীরা।’ তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে সিয়াম আহমেদও জানায় তার ক্ষোভের কথা। সিয়াম বলে, ‘সরকারি মাঠে সবারই প্রবেশের অধিকার আছে। এ কারণে অনেক চেষ্টা করেও ক্লাবের লোকজন আমাদের আটকে রাখতে পারেনি। এখন সব আন্দোলন বন্ধ থাকায় আবারও মাঠে প্রবেশের ক্ষেত্রে তারা বাধা দিচ্ছে।’স্থপতি ইকবাল হাবিব গতকাল শুক্রবার  বলেন, ‘মহামান্য আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও একটি মহল মাঠটিতে সাধারণ জনগণকে প্রবেশে বারবার বাধা দিচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা ডিএসসিসির প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি, সাক্ষাৎও করেছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, ডিএসসিসির জনবল দিয়ে মাঠের সার্বিক কাজ পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি মাঠে পুনরায় সাধারণ মানুষ প্রবেশের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে।’ ইকবাল হাবিব আরো বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আগে আমরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। আদালতে সরকারি এ মাঠের পক্ষে শত রকমের দালিলিক প্রমাণ দাখিল করেছি। পক্ষান্তরে ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের পক্ষে কোনো ধরনের প্রমাণ দেখাতে পারেনি। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে নীরব থাকছে।জানা যায়, ধানমণ্ডি মাঠ নিয়ে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ইকবাল হাবিব, ফারজানা শাহনাজসহ স্থানীয় ছয় বাসিন্দা। তাঁদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করছেন ফিদা এম কামাল ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন। মামলায় আদালত এখনো কোনো নির্দেশনা দেননি বলে জানা যায়।মাঠ ঘুরে দেখা যায়, স্থাপনা নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কংক্রিট ও রডের বেষ্টনীর অংশ মাঠের একপাশে ফেলে রাখা। এ মাঠে এক কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে দুটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট এবং দুটি টেনিস ও একটি বাস্কেটবল কোর্ট। কাজ করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (পরিকল্পনা) শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ধানমণ্ডি মাঠে অনুমোদন ছাড়া স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে বলে যখনই আমরা খবর পেয়েছি, তখনই আমাদের অথরাইজড অফিসারের মাধ্যমে বিধি অনুযায়ী কাজ বন্ধ করতে ডিএসসিসি ও এলজিইডিকে পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর মেলেনি।’ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাঠের স্থাপনা নিয়ে রাজউক আমাদের চিঠি দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু নির্মাণাধীন কাজটি কোনো ইমারত নয়, তাই এখানে রাজউকের নির্দেশনার কোনো সুযোগ নেই।’এ বিষয়ে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাঠে কোনো বড় ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। ফলে আমরা আইন অমান্য করে স্থাপনা নির্মাণ করছি- এ কথা সঠিক নয়।’স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর শেখ জামাল ধানমণ্ডি মাঠের চারদিক প্রাচীর তৈরি, স্থাপনা নির্মাণ ও সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করাসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে বছর ধরেই আন্দোলন করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন ও স্থানীয় লোকজন। এ নিয়ে প্রথমে কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের আন্দোলন পরে স্থানীয় জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। প্রায় প্রতি শুক্রবারই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ চলেছে মাঠটি ঘিরে। মাঠ রক্ষায় গত ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী, রাজউক ও ডিএসসিসি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়। অনেক আপত্তি আর উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও এরই মধ্যে মাঠের প্রায় অর্ধেক দখল করে তৈরি করা হয়েছে স্থাপনা। ডিএসসিসি ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দাবি, ক্রীড়া স্থাপনা নির্মাণ করতে আইনগত কোনো বাধা ছিল না। তাই স্থাপনা নির্মাণ থেকে পিছু হটেনি তারা। এক কপর্যায়ে মাঠে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ক্লাবের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের নামে মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু তীব্র আন্দোলনের মুখে ডিএসসিসির ম্যাজিস্ট্রেট মো. অতুল মণ্ডলের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য গিয়ে মাঠের গেট খুলে তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। একই সঙ্গে গেটে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয় যাতে লেখা ছিল, ‘ধানমণ্ডি মাঠের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, এ মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত’। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

Advertisement