বিশেষ প্রতিবেদন

‘স্বীকৃতি’ পুলিশে নারীদের আরও এগিয়ে নেবে

‘সময়ের বিবর্তন আর সভ্যতার বিকাশে নারীদের পিছিয়ে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান সরকারের অধীনে নারীর রয়েছে নিজেকে মেলে ধরার অপার সম্ভাবনা। সৎ, মেধাবী ও কর্মঠ নারীরা পুরুষের তুলনায় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নিজেদের নারী না ভেবে কর্মঠ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাই ভাবতে হবে।’

Advertisement

বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত নারীকর্মীদের উদ্দেশ্যে এভাবেই নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের কর্মকর্তা নিশাত রহমান মিথুন। ডিবি, উত্তরের গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিমের সিনিয়র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এ কর্মকর্তা।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে কর্মক্ষেত্রে নারী সদস্যদের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন অ্যাওয়ার্ড- ২০১৭ প্রদান করা হয়। সাত ক্যাটাগরিতে দুটি প্রতিষ্ঠান এবং ২১ নারী পুলিশ সদস্য এ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। তাদের একজন ডিএমপির এ নারী গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

‘নারী-পুরুষের সমতায় উন্নয়ের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা’ স্লোগানকে যথোপযুক্ত মনে করেন তিনি। জাগো নিউজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগ্যতা, পদায়ন, অধিকার, মর্যাদা ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কথা বলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিশাত রহমান মিথুন।

Advertisement

জাগো নিউজ : এই প্রথম কাজের স্বীকৃতি পেলেন। কেমন লাগছে?

নিশাত রহমান মিথুন : খুবই ভালো লাগছে। আজ তো ভালো লাগার দিন। নিজের কাজের স্বীকৃতি পাওয়া যে কারোর জন্যই ভালো লাগার। জাগো নিউজ : পেশা হিসেবে পুলিশে নারীরা কেমন করছেন?

নিশাত রহমান মিথুন : নারীরা এখন অনেক ভালো করছেন। স্বীকৃতিই এর প্রমাণ। পুলিশে এমন অনেক কাজ রয়েছে যেগুলো পুরুষের তুলনায় নারীরাই বেশি পারদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছেন। এছাড়া বিসিএস দিয়ে সমযোগ্যতায় ক্যাডার হচ্ছেন। কর্মঘণ্টাতেও নেই তফাত। নারীদের মধ্যের সেই গোড়ামিও কমেছে। যোগ্যতার মাপকাঠিতে পুলিশে নারীদের যথেষ্ট ভালো করার সুযোগ রয়েছে।

জাগো নিউজ : পুলিশে নারীদের অবস্থান আগের চেয়ে এখন ভালো। বাহিনী থেকে আরও অগ্রগতির সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাহিনী হিসেবে পুলিশে নারীদের কাজের চ্যালেঞ্জ কেমন? অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলেন।

Advertisement

নিশাত রহমান মিথুন : রুট লেভেল থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এখন নারীদের বিচরণ। আসলে যোগ্যতা না থাকলে এমনটি হওয়ার সুযোগ ছিল না। নারীরা যোগ্যতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। কাজের চ্যালেঞ্জ সবখানেই আছে, থাকবেও। সব মোকাবেলা করেই পুরুষের ন্যায় নারীদেরও টিকে থাকা। নারী নয় বরং কর্মকর্তা হিসেবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য যদি আমি পালন করে যেতে পারি, তবে কোনো বাধাই আটকাতে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।

জাগো নিউজ : নারী হিসেবে গাড়িচোর প্রতিরোধ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন? কখনও কি সমস্যা কিংবা বিপদজনক মুহূর্ত আসেনি?

নিশাত রহমান মিথুন : এমন অনেকবারই এসেছে। একবার তো টেকনাফে গাড়িচোর সিন্ডিকেট ধরতে এবং গাড়ি উদ্ধারে দুই রাত নির্ঘুম কেটেছে। যদিও সজাগ থেকে অভিযান সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি। কিন্তু হামলার শঙ্কা ছিল। কৌশলী ভূমিকা ও সহকর্মীদের সহযোগিতায় তা উতরে এসেছি। সোর্স নিয়োগ, সিডিআর অ্যানালাইসিস, বিআরটিএ রেকর্ড অ্যানালাইসিস ইত্যাদি করে ছুটে বেড়াতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

জাগো নিউজ : পুলিশ বাহিনীকে আরও এগিয়ে নিতে কিভাবে কাজ করছেন?

নিশাত রহমান মিথুন : প্রথাগত ধারণা ও কুসংস্কারে এখন কেউ বিশ্বাস করে না যে নারীদের দিয়ে কিছু হবে না। আগে তো নারীরাই নিজেদের আড়ালে রাখতেন। এখন সব দিক থেকে নারীদের এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস চলছে। যেটা নারীকে অটোমেটিক চয়েসে এগিয়ে রাখছে। নারী ভিকটিমদের উদ্ধারে নারী পুলিশই দরকার। ফলে এখন নারীদের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এছাড়া পুরুষরা যেসব কাজ করেন সেসবের ক্ষেত্রে নারীরা আর পিছিয়ে নেই। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রমাণ দিচ্ছেন নারীরা।

গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ও আহতদের সেবায় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ওই সময় সিটি, ডিবি কর্তৃক পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে নারী জঙ্গিদের গ্রেফতার এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সহায়তা করেছেন নারী কর্মকর্তারা।

জাগো নিউজ : ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক’ নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কিভাবে কাজ করছে?

নিশাত রহমান মিথুন : পেশাদারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকারে শিক্ষার্থীসহ সমাজের অন্যান্যদের মাঝে পারিবারিক সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদকের প্রসার, যৌতুক ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক। বন্যার্তদের সাহায্য প্রদান, শীতার্তদের বস্ত্র বিতরণ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও মাতৃভাষা দিবসসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

জাগো নিউজ : সহকর্মী কিংবা সিনিয়র কর্মকর্তাদের আচরণ পেশার ক্ষেত্রে সহায়ক কিনা?

নিশাত রহমান মিথুন : এটা আমি কখনই ভুলব না। আমার টিমে অসাধারণ সহযোগী ও সহমর্মী সহকর্মী রয়েছেন। আমার বিভাগের ডিসি নাজমুল স্যার শুধু আমার বস নন তিনি বাবার মতো করেই সবক্ষেত্রে সহযোগিতা করে আসছেন। আমার পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। পুলিশে আসার আগে নিজের ধারণাটাও বিশেষ ভালো ছিল না। কিন্তু এর সবই বদলে গেছে।

জাগো নিউজ : কৃতিত্বের স্বীকৃতি পাচ্ছেন। পুরস্কার, পদোন্নতির মাধ্যমে পাওয়া স্বীকৃতি কি নারীদের পুলিশ বাহিনীতে আরও এগিয়ে নেবে বলে মনে করেন?

নিশাত রহমান মিথুন : অবশ্যই, কেন নয়? যে কারও ভালো কাজ কিংবা কৃতিত্বের স্বীকৃতি আরও ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। অন্য সহকর্মীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা তৈরি করে। ২০১৬ সালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি, উত্তর) গাড়িচুরি প্রতিরোধ টিমের লিডার হিসেবে সর্বাধিক সংখ্যক চোরাই গাড়ি উদ্ধার করায় পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে মোট আটবার শ্রেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনারের পুরস্কার পেয়েছি। এবার উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড পেলাম। এ সবই আমাকে একটি উচ্চতায় নিয়ে যাবে। কাজের মাধ্যমে স্বীকৃতি পেয়েছি, ভবিষ্যতেও আরও ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা যোগাবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি অ্যান্ড উড টেকনোলজিতে পড়াশোনা শেষে ২০১২ সালে ৩০তম বিসিএসে পুলিশে যোগ দেন গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার বাসিন্দা নিশাত রহমান মিথুন।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি, উত্তর) গাড়িচুরি প্রতিরোধ টিমের প্রধান হিসেবে ২০১৬ সালে তার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চুরি যাওয়া এবং চোরাই সন্দেহে একটি পাজেরো জিপ, ৪০টি প্রাইভেটকার, ২৩টি মাইক্রোবাস, ৪৭টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, একটি পিকআপভ্যান এবং ১৯টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ৩০ আসামিকে গ্রেফতার এবং তাদের বিভিন্ন মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হয়।

২০১৬ সালে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহিলা বিষয়ক সহ-সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

জেইউ/এসআর/এমএআর/এমএস