‘এই ভাগ, তোগো (তোদের) লাইগ্যা (জন্য) শিশু পার্কের রাইড খোলা বুধবার। আইজ (আজ) টিকিট থাকলেও রাইডে চড়তে পারবি না।’ সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার জাতীয় শিশু পার্কে প্রতিটি রাইডের সামনে দীর্ঘ লাইন। বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৪টায় ব্যাটারিচালিত গাড়ির রাইডের বাইরে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে লাইনে খালি গায়ে চার শিশু। সুন্দর পোশাক পরিহিত শিশুদের পাশে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠিক এভাবেই ধমকে লাইন থেকে বের হয়ে যেতে বলছিলেন কর্তব্যরত টিকিট পরীক্ষক (চেকার) আবদুল বারেক। শিশু চারজন ছলছল চোখে টিকিট পরীক্ষকের কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে ভয়ে ভয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘অনেক কষ্টে ট্যাকা জমাইয়া রায়েরবাজার থেকে হাইট্টা হাইট্টা আইছি। দয়া কইরা আমাগো রে খেদাইয়া দিয়েন না, গাড়ি চালাইতে দ্যান।’ কিন্তু নাছোড়বান্দা আবদুল বারেক। তিনি কিছুতেই ওদের লাইনে দাঁড়াতে দেবেন না।একটু ভালো করে খেয়াল করতেই লাইনে দাঁড়ানো অন্যান্য প্রায় অর্ধশত শিশুর তুলনায় ওরা যে ব্যতিক্রম তা সহজেই বোঝা যায়। ওদের বয়স আনুমানিক সাত থেকে নয় বছর। চারজনের তিনজনের শরীর উদাম। পরনের প্যান্টেরও রং ঝলসানো। গরমে দর দর করে ওদের শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল। অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে অভিভাবক থাকলেও ওদের সঙ্গে কেউ নেই। অন্যান্য শিশুদের বাবা-মা ও স্বজনরা আদর করে রুমালে মুখ মুছে শীতল পানি ও কোমল পানীয় এগিয়ে দিলেও ওরা চুপচাপ চারটি টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌতূহল নিয়ে চার শিশুর সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ওদের নাম মানিক,আহাদ, জাহিদ ও রিয়াদ। মানিক ও আহাদের বাবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা, জাহিদ ও রিয়াদের বাবা বাস চালক। ওরা রায়েরবাজার বধ্যভূমির পাশের একটি বস্তিতে থাকে। ওরা চারজন গত কয়েকদিন ধরে প্রত্যেকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিস্কুট ও চকলেট খাওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে সেই টাকা জমিয়ে শিশু পার্কে ঘুরতে এসেছে। ওরা ধানমন্ডি ১৫ নম্বর পর্যন্ত পায়ে হেটে এসে তারপর বাসে চড়ে শাহবাগ নেমে পার্কে ঢুকেছে। এই চার শিশুকে প্রবেশ না করতে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে শিশু পার্কের টিকিট পরীক্ষক আবদুল বারেক বলেন, এসব গরিব উদাম গায়ে শিশুদের লাইনে দাঁড়াতে দেখলে অনেকেই নাক সিটকায়। অনেকে শিশুদের লাইন থেকে বের করে নিয়ে যান। তাদের ডেকে বকাঝকা করে। এ কারণে টিকিট থাকলেও গরিব শিশুদের লাইনে দাঁড়াতে দেন না বলে জানান তিনি। আবদুল বারেক জানান, গরিব শিশুদের জন্য সরকারিভাবে বুধবার শিশু পার্ক খোলা থাকে। এদিন তাদের বিনা টিকিটে সব রাইডে চড়ার সুযোগ দেয়া হয়। অন্যান্য দিন টিকিট থাকলেও তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। শিশু চারটিকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং তাদের বের করে দিতে দেখে বেশ কয়েকজন অভিভাবক প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। লালবাগের খাজে দেওয়ান প্রথম লাইনের বাসিন্দা গৃহবধু রাহেলা খাতুন বলেন, শিশু পার্কে এ ধরনের বৈষম্য থাকা মোটেই উচিত নয়। শিশুদের বিনোদনের জন্যই এ পার্ক। এ সব শিশুদের মধ্যে গরিব ধনীর দেয়াল তুলে দূরে ঠেলে দেয়া উচিত নয়। মিরপুরের পাইকপাড়া থেকে দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে শিশু পার্কে এসেছেন ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন মিয়া। ওই চার শিশু তার ছেলেদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আবদুল বারেকের সঙ্গে রীতিমতো তর্কে জড়িয়ে যান তিনি। তিনি এই চার শিশুর পোশাক না থাকার কারণে রাইডে চড়তে না দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেবেন না বলে জানালেন। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরও কয়েকজন অভিভাবক শিশুদের রাইডে চড়তে দেয়ার দাবি জানান। এরপর অবশেষে আবদুল বারেক রাজি হন। লাইন অনুসারে প্রথমে চার শিশুর দুজনের ডাক পড়ে আর অন্য দুজন অপেক্ষায় থাকে। রাইডে চড়ার পর ওদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। দক্ষ চালকের মতো ওরা একবার গাড়ি ডানে একবার বামে ঘুরাচ্ছিল। রাইডে চড়ার অপেক্ষায় থাকা অন্য দুজন জোরে চিৎকার করে অন্য দুজনকে নির্দেশনা দিচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে প্রতিবাদমুখর অভিভাবকদের বেশ আনন্দিত হতে দেখা যায়। এ সময় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক শিশু চারজনের ছবি তুললে ওদের একজন প্রশ্ন করে, ‘আমাগো ছবি কি আবার ফেসবুকে দিবেন?’ এ কথা শুনে উপস্থিত সকলেই সমস্বরে হেসে উঠেন। এমইউ/এমএমএ
Advertisement