পানিতে তলিয়ে গেছে ধান, এরপর দূষিত পানিতেই মরেছে মাছ এবং হাঁস। অনেকের গো-খাদ্যের অভাবে গবাধিপশুও মারা গেছে। পুরো এলাকায় কাজের কোনো সুযোগ নেই। দেখা দিয়েছে ভাতের সংকট। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে বাড়ি ছাড়ছেন হাওরপাড়ের মানুষ। কাজের সন্ধানে শহরে ছুটছেন সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের সব হারানো নিঃস্ব নারী-পুরুষেরা।
Advertisement
গত কয়েকদিন ধরেই সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ উপজেলা শহরের লঞ্চঘাটে মানুষের ভিড়। এদের বেশিরভাগই গ্রাম ছেড়ে শহরের যাত্রী। বেশির ভাগের লক্ষ্য বিভাগীয় শহর সিলেট ও ঢাকা। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও কাজের আশায় শহরমুখী হয়েছেন।
তবে কাজে আশায় গ্রাম ছাড়ার কোনো তথ্য নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (যুগ্ম সচিব) শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ফসল তলিয়ে গেলেও এখনও তেমন খাদ্যসঙ্কট দেখা দেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচুর সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাই কাজের জন্য গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
তবে জেলা প্রশাসক এমনটি জানালেও সরেজমিনে হাওর এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। সুনামগঞ্জের অনেক হাওর এলাকায় এখনও সরকারি ত্রাণ পৌঁছায় নি। আবার পৌঁছালেও এর পরিমান খুবই কম। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই পাচ্ছেন না। অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
Advertisement
জামালগঞ্জের সাচনাবাজার ঘাট থেকে গত বুধবার লঞ্চে করে সুনামগঞ্জ শহরের উদ্দেশে রওয়ানা দেন ওই উপজেলার ভীমখালি এলাকার বাসিন্দা আবুল কাসেম।
তিনি বলেন, আমাদের তো সব গেছে। ঘরে কোনো খাবার নাই। বাইরে কোনো কাজ নাই। তাই বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছি। লঞ্চে করে জামালগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ, তারপর বাসে করে সিলেট যাবেন বলে জানান তিনি।
মঙ্গলবার কাজের আশায় স্বপরিবারে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার প্রতাপুর গ্রামের পরিন্দ্র দাস। তিনি বলেন, এ বছর প্রায় আট একর জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। সবটুকুই পানিতে তলিয়ে গেছে। অন্য বছর ধান গেলে মাছ ধরে সংসারের খরচ চলে যেত। এবার তো মাছও মরে গেছে। ছিলো ৫০/৬০টি হাঁস সেগুলোও মরেছে। এ অবস্থায় বাড়িতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।
তিনি বলেন, হাওরে আরও অনেক দুর্যোগ এসেছে। কখনই এবারের মতো ভয়াবহ নয়। কোনোদিন কাজের জন্য গ্রাম ছাড়তে হবে ভাবিনি। এবার বাধ্য হয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকা চলে যাচ্ছি। লঞ্চে করে ভৈরব হয়ে ঢাকা যাবেন বলে জানান তিনি।
Advertisement
শাল্লা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রান্টু লাল দাশ বলেন, অনেক এলাকায় বাড়ি-ঘরে তালা ঝুলিয়ে লোকজন শহরে চলে গেছে। আমাদের গ্রাম থেকে গত কয়েকদিনে অন্তত ২০টি পরিবার শহরে চলে গেছে।
তিনি বলেন, হাওর এলাকায় এখন কাজের কোনো সুযোগ নেই। সরকার ওএমএসের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রি করলেও তা বেশিরভাগ মানুষই পায় না। অন্যান্য যে ত্রাণ কার্যক্রমের কথা বলা হচ্ছে তা এখনও শুরু হয়নি। তাই মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালিব খান বলেন, পানি বেড়ে যাওয়ায় এখন বালুমহাল ও পাথর কোয়ারিতে কাজ বন্ধ রয়েছে। এগুলোতে এখন কাজ করার সুযোগ নেই। আর সরকারি সহযোগিতা একেবারে অপ্রতুল। তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে না।
তিনি বলেন, সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে মধ্যবিত্ত কৃষকরা। যারা ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। আবার ঘরেও খাবার নেই। এরকম অনেকেই গ্রাম ছেড়ে কাজের জন্য শহরে চলে যাচ্ছেন।
কাজের খোঁজে হাওরের মানুষ শহরমুখী হওয়া প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ লে. কর্নেল সৈয়দ আলী আহমদ (অব.) বলেন, হাওরপাড়ের মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ওই এলাকায় করা না গেলে শহরের উপর মানুষের চাপ বাড়বে। অতিরিক্ত মানুষের চাপ ঢাকা বা সিলেট কতটা নিতে পারবে সে প্রশ্নও রাখেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে সব হারানো এই মানুষগুলোর জন্য সত্যিকার অর্থে সহায়তার হাত বাড়ানো। পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এই মানুষগুলোকে গ্রামে রাখতে হবে। এটি ব্যর্থ হলে শহর ও গ্রামে চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমএএস/পিআর