থেরেসা মে নতুন নির্বাচনের ডাক দিয়েছেন। ধারণা করা সহজ, বৃটেন এখন ব্রেক্সিট চিন্তা সরিয়ে রেখে নির্বাচনী স্রোতে গা ভাসাবে। আমাদের দেশের নির্বাচন হলে তেমনটা হত, চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। বৃটেনেও কি তা-ই হচ্ছে? কৌতুহল কুড়কুড় করে উঠতেই চোখ-কান খুলে দিতে হল। বৃটেনে বন্ধুবান্ধব আছে, অনলাইনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে নানান কথাবার্তা, সাথে বৃটেনের পত্র-পত্রিকা তো আছেই।
Advertisement
প্রশ্নটা এরকম ছিল, ব্রেক্সিট কি ভাল হবে? উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’-এর মধ্যেই থাক্, এ নিয়ে চাপাচাপি করেও লাভ হয় না। মনের দরজা খুলে যায়, গড়গড় করে বেরিয়ে পড়ে মনের কথা। বৃটিশ ‘শিট’ সমাপ্তি হয়ে ঝুলতে থাকে সব কথার শেষ কথা হিসেবে।
কী যে হ’ল সভ্য বৃটিশদের! সত্যি বলতে কি, বৃটিশ বলতে আমি যা বুঝি, তার গোড়াতেই পড়ে গেছে টান। এই যেমন ধরুন, সকাল বেলায় গলায় ন্যাপকিন ঝুলিয়ে কাঁটা চামচ আর ছুরি হাতে টেবিলে বসা গুরুগম্ভীর বৃটিশ ব্রেকফাস্ট করছেন, এরকম ভাবনা স্বাভাবিক ছিল এতকাল। ভদ্রজনোচিত সানডে লাঞ্চের বেলায়ও দৃশ্যপট একই থাকে বৈকি। চেঁচামেচি উঠে গেছে ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ কেন, ডিনারের টেবিলেও। গৎবাঁধা বৃটিশ ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনারের স্বাদ এখন খোদ বৃটিশদেরও সুবিধের লাগে না।
অভিবাসীদের কল্যাণে ভারতীয় ডিশের স্বাদ জিভে লেগে গেছে। মেক্সিকান ডিশ চোখের পানি ঝরানোর সাথে সাথে প্রাণও হরায়। এছাড়া ইউরোপিয়ান খাবারের বৈচিত্র্য কি কম? কলোনিবাজ বৃটিশরা দেশে দেশে কলোনি স্থাপন করেছে আর নিজেদের খাবারের মেন্যুতে নানান দেশের খাবারের এটাসেটা যোগ করেছে। পিওর বৃটিশ হতে গেলে তো সেসবও বাদ দিতে হবে। গড়পড়তা বৃটিশদের ভেতর ধারণাটা এরকম- ইউরোপিয়ানরা আমাদের চেয়ে ভালো খায়। একজন বললেন, ফ্রান্সে দেখবেন, খুব কম দামে তাজা আর মজাদার রান্নার কত বাহার। বৃটেনে এরকমটা আপনি ভাবতেও পারবেন না। ব্রেক্সিটের পর চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে, ও পারেতে ইউরোপিয়ানদের সব সুখ বাস করে। টেবিলে তখন সাজানো থাকবে পিওর বৃটিশ ‘বোরিং’ সব খাবার। শিট!
Advertisement
এরপর আসুন, বৃটেনের আবহাওয়ার প্যাঁচালে। জুলাই মাসে ১৮ ডিগ্রি, সাথে আবার প্যাঁচপেচে বৃষ্টি। এই সময় বৃটেন থেকে পালিয়ে ইউরোপের কোন দেশে গিয়ে দম ফেলার হিড়িক পড়ে। ব্রেক্সিটের পর এ আর সম্ভব হবে না। পচে মরো, আর কি। শিট!
ইউরোপের ৫০৭ মিলিয়ন অধিবাসীর ভেতর ৮৯ মিলিয়নেরই বয়স হচ্ছে ১৫ থেকে ২৯-এর ভেতর। নির্ভরশীল বলে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত যারা, তাদেরকে হিসেব থেকে বাদ দিন। এর পরের যারা, তারা ব্রেক্সিটের পর আর ইউরোপিয়দের সাথে প্রেমের সুযোগ পাবে না। ছোট্ট বৃটেনেই ছুঁড়তে হবে প্রেমের তীর, ফিরে যেতে হবে প্রাচীন কালের সেই মিশনারী পদ্ধতির প্রেমালাপে। কেননা, বৃটিশদের ধারণা, ইউরোপিয়ানরা আসলেই নাকি গুডলুকিং। মনটা বড্ড খারাপ তরুণ বৃটিশদের, এই জন্যে। শিট!
সঙ্গীতপ্রেমীদেরও মন বড্ড খারাপ। বছরে প্রায় ৬০০-এর মতো সঙ্গীত উৎসব জমে ওঠে ইউরোপ জুড়ে। এখন সঙ্গীতে প্রাণ মজাতে গেলে অর্থ ব্যয় করতে হবে আগের চেয়ে অনেক বেশি। আর তাই ব্রেক্সিট চালু হওয়ার আগেই তোড়জোড় পড়ে গেল সঙ্গীত সমঝদারদের, উৎসবগুলোতে যোগ দিতে চায় তারা। ব্রেক্সিট হলে এসব আর চলবে না। চলবে না ধুমপায়ী হওয়া। কেননা ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে ধুমপানে খুব একটা কড়াকড়ি নেই, যতটা আছে বৃটিশ সমাজে। শিট!
বিলাতে ব্যারেস্টারি পড়তে যাওয়া বাঙালি সমাজের গর্বের বিষয় ছিল বটে। তবে, আরো অনেক দেশের বিদ্যাপ্রত্যাশীদের মতো বাঙালিরাও দুঃশ্চিন্তায় আছে। বৃটেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বেড়ে যাচ্ছে পাগলা গতিতে। এর তুলনায় ফ্রান্সে সে খরচ নামে মাত্র। আর জার্মানীতে তো ফ্রি। বৃটেনের কলেজ পড়ুয়া এক মেয়ে টুইট করেছে, তার কলেজ নাকি তাকে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে। যে খরচ তার হবে, তা দিনরাত খেটেও কুলাতে পারা সম্ভব হবে না তার জন্য। সত্যিই ব্রেক্সিট, শিট!
Advertisement
কফি খেতে চাইলে ইউরোপই ভাল। সত্যি বলতে কি, ইতালিয়ান বা ফ্রেঞ্চ কফি চান, যদি সত্যিই কপির স্বাদ পেতে চান। কোস্টার চেয়ে অনেক গুণে ভাল। শুধু কি কফি? ইউরোপিয় ইউনিয়ন এর সব সদস্য দেশে ২০২০ সাল নাগাদ ওয়াইফাই দিয়ে দেবে। সস্তা ইউরোপিয়ান ফ্লাইটগুলো নাকের ডগা দিয়ে ভোঁ করে উড়ে যাবে আকাশে, বৃটিশরা চেয়ে চেয়ে দেখবে। সীমানাহীন, ভিসাহীন ভ্রমণের সুখ আর মিটবে না। অন্য দেশে গিয়ে যদি শোনে, ইংরেজি উচ্চারণটা তারা ঠিক মতো করেনি, তবে বৃটিশদের আর নাক কুঁচকানো জমবে না।
একজন তো বললেন, যে দেশে যাব, বৃটিশ পাসপোর্ট দেখলেই নাক কুঁচকাবে। বলবে, এরা সেই লোক, যাদের মাঝে দেশপ্রেম নেই। বলবে, হেই বৃটিশ তোমাদের রানী আছে না? আহা, ওরা রানীকে ঘৃণা করবে! সত্যি বলতে কি, বৃটিশদের প্রতি শত শত বছরের যে ঘৃণা জমে আছে দেশে দেশে, তারই যে উদগীরণ চলবে। শিট!
খুব মজা পেলাম। ইউরোপের মানুষরা নাকি কমপক্ষে দুটি ভাষায় কথা বলতে পারে। আর বৃটিশরা পারে কেবল ব্রেক্সিট! আই ব্রেক্সিট! য়্যু ব্রেক্সিট! হি নয়তো শি ব্রেক্সিট!
এই সব ভাবতে ভাবতে স্বাস্থ্যটা ভাল যাচ্ছে না। তখন ভাবতে হয়, ইউরোপিয়ানরা স্বাস্থ্যসেবায় কত বেশি পয়সা খরচ করে, সে কথা। বৃটেন তো ইউরোপের অসুস্থ রোগী, এ কথা সবাই জানে। স্বাস্থ্যসেবায় অত পয়সা খরচের ক্ষমতা বৃটেনের নেই যে।
এত সব খেদ নিয়ে ব্রেক্সিট মেনে নিতে হচ্ছে বলে খেদটা ঝাড়তে হয় থেরেসা মে’র উপরই। তিনি তো অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। ব্রেক্সিট নিয়ে এত কথা বলার তিনি কে? এই প্রশ্ন শুনে বুঝলাম, থেরেসা মে কেন নির্বাচন ডেকেছেন।
নির্বাচন হবে। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এসে ব্রেক্সিট সফল করবেন। আর তাই, কথাবার্তার শেষে সবাইকে জানিয়ে দেই শুভেচ্ছা। হ্যাপি ব্রেক্সিটিং, বন্ধু! সামনে তোমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত আশা করছি।
উল্টো দিকে তবুও মেলে না উষ্ণতার খোঁজ। আমি তাই ভাবি, আমেরিকা আর বৃটেনের মতো শত বছরের দাপুটে বুদ্ধিমান জাতিদ্বয়ের হলটা কি? আমেরিকানরা সুখেই ছিল। খাল কেটে ট্রাম্প আনল। আরেকটা কুমির আসার অপেক্ষা বৃটেনে। সুখে থাকলে ভূতে যে কিলায়, কথাটা তবে মিথ্যে নয়, কি বলেন?
লেখক : শিশুসাহিত্যিক।
এইচআর/এমএস