সাহিত্য

মাহী ফ্লোরার ‘পিতলের প্রজাপতি’ এবং কিছু কথা

মাহী ফ্লোরার `পিতলের প্রজাপতি` গল্পগ্রন্থটি হাতে আসার পরেই পড়তে শুরু করি। তিনি যতোটা আগ্রহের সঙ্গে পাঠিয়েছেন; তার চেয়েও বেশি আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করি। যেহেতু গল্পের প্রতি আমার দুর্বলতা সবসময়ের। পক্ষপাতিত্বও বলা যায়। কেননা আমিও গল্প লিখি। সুতরাং গল্পের প্রতি ভালোবাসা বরাবরই বেশি।

Advertisement

মাহী ফ্লোরা মূলত কবি। এটি তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। শুভযাত্রায় তার জন্য শুভকামনা। তবে প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসেবে এটি পরীক্ষামূলক তো বটেই। এছাড়া তিনি যেহেতু কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। এ পর্যন্ত চারটি কাব্যগ্রন্থের (যদি ভুল না করি) পর প্রথম গল্পগ্রন্থ এটি। ফলে তার গল্পের মধ্যে কবিতার স্বাদ পাচ্ছি। তিনি গল্পে রহস্যময়তা তৈরি করে রেখেছেন।

তার গল্পে মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া, ব্যক্তিগত অনুভূতি, প্রেম-বিরহ, পারিবারিক কলহ, ইতিহাস, সামাজিক অবক্ষয়, নারী জাগরণ, দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষ, সমসাময়িক সমস্যা ও সম্ভাবনা উঠে এসেছে। তবে লেখক যেহেতু নারী, তাই তার গল্পে নারী চরিত্রগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। পুরুষকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছেন। গল্পগুলো বেশিরভাগই নারীকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। কিংবা নারী চরিত্রই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সে হিসেবে বলবো, স্বজাতের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করার মতো। দৃষ্টিভঙ্গি যে একজন নারীর তা স্পষ্টতই ফুটে ওঠে।

তার গল্পগুলো বাহারি শিরোনামে সজ্জিত। অনেকটা কাব্যের আদলে। ফলে শিরোনাম দেখে গল্পের অভ্যন্তরীণ বিষয় আঁচ করতে পারবেন না। পনেরোটি গল্প পড়লেই কেবল বুঝবেন শিরোনামের মানে। তার গল্পগুলোর শিরোনাম এরকম- পিতলের প্রজাপতি, ভাঙা পেন্সিলে, এক ঝলক আলো, এ জীবন ফড়িঙের, শরতের একদিন, হাঁটতে হাঁটতে একটা নুড়ি, সূর্য প্রতিমা, রঙ্গ, মোহরানা, ফুল চকমকি মেঘের আরেক নাম, তুমি কোন গগনের তারা, আর মেঘেরা চুপ করে পালালো, খেলাঘর, শাখানদী, যাত্রার রাজা।

Advertisement

ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। পাঠককে আকৃষ্ট করার মতোই তার আয়োজন। ভালো লাগা বা ঘোর তৈরি হতে পারে। তবে ঘোরটি স্থায়ী করতে আরো কিছু কাজের প্রয়োজন ছিলো। যা হয়তো তার অলক্ষ্যেই রয়ে গেছে। তবে লেখক সফল হবেন, বাহবা পাবেন; যদি গল্প দিয়ে ছুঁয়ে যেতে পারেন পাঠকের মন। কিছুটা অসঙ্গতিও ধরা পড়ে তার গল্পে। ‘পিতলের প্রজাপতি’ গল্পে লেখক বললেন, ‘বাড়িটাতে আমি থাকি আর আমার স্বামী থাকেন। এ রাতে হঠাৎ মনে হলো আটা নেই। সকালে বুয়া বলেছিল উনি ফেরার পথে আনতে ভুলে গেছেন। রাস্তার ওপাশে দোকান। বৃষ্টিতে আটকা পড়লেন না তো?’ এ কথার পর গল্প কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। তার কাঙ্ক্ষিত গন্তেব্যে পৌঁছতে পারেনি। গল্প শেষ হয়েছে। সেদিনের পরের দিনের ঘটনাও এসেছে- কিন্তু বৃষ্টিতে আটকা পড়া স্বামী আর বাসায় এসেছেন কি না জানি না। বিষয়টি অস্পষ্টই রয়ে গেছে।

তবে তার গল্পে মজার বিষয়ও লক্ষ্য করেছি। শোকার্ত বাড়িতে কামোন্মত্ত পুরুষকেও হাজির করেছেন তিনি। তিনি পুরুষের বিকৃত রুচি উপস্থাপন করেছেন। কেননা নিজের বাবাকে কবরে রেখে এসে প্রথম শোকের রাতেই স্ত্রী সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয় ছেলে। লেখকের ভাষায়, ‘লতার খুব অবাক লাগে। বাবু ঘুমাতেই লোকটা অন্যরকম হতে থাকে। একটু আগের শোকার্ত পুরুষ কামোন্মত্ত হয়ে ওঠে।’ দৃষ্টিকটু মনে হলেও এমন ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে বা ঘটতে পারে। ‘সূর্যপ্রতিমা’ গল্পে ‘আহসানুল হক ইনু’ নামটি সম্ভবত ভুলবশত হয়েছে। এখানে ‘হাসানুল হক ইনু’ হওয়ার কথা নিশ্চয়ই। একই গল্পে একটি বাক্যে ‘ঢাকার মাটিতে পা দিয়েছেন ইলা মিত্র’- তার একটি বাক্য পরেই ‘ইলা মিত্র দীর্ঘদিন পর আসছেন নাচোলে’। অর্থাৎ ইলা মিত্র প্রথমে ঢাকা এসেছেন; সেখান থেকে যাচ্ছেন নাচোলে। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করা দরকার ছিলো মনে হয়। ‘এ জীবন ফড়িঙের’ গল্পে ‘মাগরেবের নামাজ পড়ে বুকে ব্যথা’ না হয়ে ‘মাগরেবের নামাজ পড়ার পর বুকে ব্যথা’ হওয়ার কথা। অর্থাৎ বুকে ব্যথার কারণ নামাজ নয়। গ্যাসের ব্যথা। তাই বড় ছেলের বউ ওষুধও দিয়েছে।

এসব ছোটখাটো বিষয় বাদ দিলে তার গল্পের নিতাই, নাসিরের মা, মালাবানু, নীতু, হাসান সাহেবদের জন্য মায়া হয়। বিষাদে ভরে ওঠে মন। নীতু যখন মনে মনে বলে, ‘এভাবে সময় হওয়ার আগেই বিয়েটা না করলেও পারতে ছোড়দা’। তখন জগতের সব ব্যর্থ প্রেমিকার কথাই মনে পড়ে যায়। লেখক গল্পের প্লট নির্বাচন, কাহিনি নির্মাণ, শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পে গল্পে পাঠক হৃদয়ে হয়তো স্থান করে নেবেন।

তবে দুর্বল দিকও কম নেই। নামকরণে কাব্যময়তা রয়েছে কিন্তু গল্পের নামকরণে তা যথার্থ হয়নি বলে মনে হয়েছে। প্রতিটি গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নামকরণের অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। তার গল্পে স্থান কাল পাত্রের ঐক্যও যথাযথভাবে রক্ষিত হয়নি। বর্ণনায় অনেক শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে। আরেকটু যত্ন বা সময় নিলে আরো ভালো কিছু উপহার দিতে পারতেন।

Advertisement

পরবর্তীতে যে কাজগুলো করণীয় বলে মনে হয়, কাহিনির অবস্থান বা প্রেক্ষাপট পরিষ্কার করতে হবে। গল্পটি লেখক সৃষ্টি করেছেন, তবে পাঠকের কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে পৌঁছে দিতে হবে তাকেই। তাই তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে পাঠকের চোখের সামনে দৃশ্যপটটি উন্মোচন করা জরুরি। লেখকের অন্তরে যা বিদ্যমান তা পাঠকের সামনেও বিরাজমান থাকতে হবে। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে `অন্তরে অতৃপ্তি রবে` কথাটা মানলেও সে অতৃপ্তি যেন অস্পষ্ট না হয়। ঘটনার পরিণতি বা ফলাফল নিয়ে পাঠক অতৃপ্ত থাকুক। তবে গল্পে যেন অস্পষ্টতা না থাকে। কবিদের গদ্যে কাব্যের প্রভাব থাকবেই, তবু গদ্য তো গদ্যই হওয়া চাই। গদ্যকবিতা যেন না হয়। গদ্যের অস্পষ্টতা পাঠকের সঙ্গে প্রবঞ্চনার শামিল। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। দুর্বল দিকের চেয়ে সবল দিকও কিন্তু কম নয়। যথেষ্ট শক্তিশালী তার গল্প বলার ধরন।

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পরাবাস্তববাদের আহ্বান, জাগতিক চিন্তা, অজাগতিক আকাঙ্ক্ষা- সাবলীলভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। সেজন্য তিনি সাধুবাদ পেতেই পারেন। যাবতীয় অসঙ্গতিগুলো কাটিয়ে উঠলেই বাংলা গদ্যসাহিত্যে তার আসন স্থায়ী হবে বলে আমার বিশ্বাস। একজন পাঠক হিসেবে আমার দাবি, সব ধরনের নেতিবাচক সমালোচনাকে মাথা পেতে নিয়েই তিনি এগিয়ে যাবেন পরবর্তী সৃজনকর্মে। এই প্রত্যাশায় নিরন্তর শুভকামনা তার জন্য। ধন্যবাদ দেশ পাবলিকেশন্সকে একজন গল্পকারকে আমাদের সামনে হাজির করানোর জন্য।

প্রকাশনী : দেশ পাবলিকেশন্সপ্রচ্ছদ : ধ্রুব এষমূল্য : ১৬০ টাকাপ্রকাশকাল : বইমেলা ২০১৭

এসইউ/পিআর