ফিচার

যে ছবি স্বপ্ন দেখায়

ধসে যাওয়া ভবনটিতে শাহিনা এমনভাবে আটকা পড়েছিল, ১১০ ঘণ্টা প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে বের হতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, চেষ্টা ছিল অনেকেরই। যখন আরেকটু হলেই তাকে উদ্ধার করা যাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখনই সম্ভবত লোহা কাটার মেশিন থেকে আগুন লেগে গিয়েছিল। যে কারণে সেখানেই প্রাণ হারান তাকে উদ্ধার করতে যাওয়া একজন। আগুন নেভানোর পরে শাহিনাকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। শাহিনা আটকপুরী থেকে বের হয়েছিল ঠিকই, তবে মৃত। শাহিনা বাঁচতে চেয়েছিল তার একমাত্র ছেলেটির জন্য। তার দুধের শিশুটি যে নিতান্তই অবুঝ!

Advertisement

রানা প্লাজা ধসের চার বছর পার হয়েছে। অনেকের কাছেই বিস্মৃত হয়ে গেছে সেই ভয়াবহ সময়, সেই বাতাসভরা লাশের গন্ধ আর স্বজনহারাদের আহাজারি। স্বাধীনতার পর এত বড় মানবিক বিপর্যয় আর ঘটেনি। কিছু লোভী মানুষের লোভের বলি হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল দেড় হাজারেরও বেশি পোশাক শ্রমিককে।

রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল কর্মীদের। কতটা অবিবেচক আর অচেতন হলে আগের দিনের ফাটল ধরা ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সেখানে কর্মীদের কাজ করতে পাঠানো হয়! যার ফলস্বরূপ আটতলা ভবনটি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়েছিল মুড়ি-মুড়কির মতো! চোখের পলকে নাই হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য প্রাণ।

যারা তখন মরে গেছেন, তারা বেঁচে গেছেন। আরও কিছু হতভাগা-হতভাগী ছিল যারা আটকা পড়ে সেখানেই ধুকে ধুকে মরেছে। চোখের সামনে এমন অনেকের করুণ মৃত্যু দেখতে হয়েছে অসহায় দেশবাসীকে। যে সময়টা আমাদের স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা সেই সময়টিতেই আমরা কিছু মুর্খ আর অচেতন মানুষদের লোভের কারণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বজনদের মৃত্যু দেখেছি। যে সাধারণ মানুষেরা এগিয়ে গিয়েছিল রানা প্লাজা ধসে আটকে পড়াদের সাহায্য করতে, সেই উদ্ধারকারীদের কেউ কেউ পরবর্তীতে দুঃসহ দুঃস্বপ্নের মতো স্মৃতি ভুলতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন! যে সৌভাগ্যবানরা শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরতে পেরেছে সেই মৃত্যুপুরী থেকে তাদের অনেকেই রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। এখনও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।

Advertisement

তবু সময় গড়িয়ে গেছে। পার হয়ে গেছে চার বছর। জীবন থেমে থাকে না। ভাঙা প্রাচীরের ফাঁকে মাথা তোলে অঙ্কুর। জীবনের প্রাচুর্য নিয়ে বেড়ে উঠতে চায় প্রতিটি জীব। রানা প্লাজার মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে আসা হতভাগ্যদের ভাগ্য হয়তো ফেরেনি। কী করে ফিরবে, তাদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই! না সরকার, না জনগণ কেউ তাদের খোঁজ করতে যায় না। দেশে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে। আমাদের আবেগ এবং সমবেদনা জানানোর নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। কে আর চার বছর আগের একটি ‘দুর্ঘটনা’কে মনে রেখে ঝামেলা বাড়াতে চায়! তবু থেমে থাকেনি তাদের জীবনপ্রবাহ। আলোকচিত্রী সৈয়দ জাকির হোসেন তার ক্যামেরায় তুলেছেন তেমনই এক ছবি। রানা প্লাজা ধসে এক পা হারানো এক নারী কর্মী, যার সৌভাগ্য হয়েছে পরবর্তীতে একটি কৃত্রিম পা লাগানোর- এমন একজন নারীর দুটি পায়ের ছবি তুলেছেন সৈয়দ জাকির হোসেন। দু`খানা পা সেই নারী সাজিয়েছেন মনের মতো করে। নেইলপালিশে রঙিন হয়ে আছে নখ, গোড়ালিজুড়ে নূপুর। দুটি পায়ের একটি প্লাস্টিকের!

ছবিটি প্রসঙ্গে আলোকচিত্রী সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, ‘অফিসের কাজেই ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। তবে মেয়েটির পা দুখানা দেখে আমার একটু ব্যতিক্রম মনে হলো। এক পা হারিয়েও মনোবল হারাননি তিনি। নিজের পা এবং কৃত্রিম পা- দুখানাই সাজিয়েছেন সুন্দর করে। মেয়েটি চাকরি করছেন না কোথাও, স্বামী তার দেখাশোনা করছেন।’ সৈয়দ জাকির হোসেন মেয়েটির নাম ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। শাহিনার নামটা আমরা জেনেছিলাম। তবু তাকে মনে রাখিনি। তাই নাম জানাটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণও নয়। জীবন যাদের দুর্নিবার, সেইসব স্বপ্নবাজ মানুষের আলাদা নামের দরকার হয় না!

এইচএন/জেআইএম

Advertisement