মেশিনের চাকা ঘুরছে। ভারী ভারী যন্ত্রের নিয়ন্ত্রিত শব্দের সঙ্গে শ্রমিকের কণ্ঠও মিলে যাচ্ছে। কথা হচ্ছে সীমিত। যা হচ্ছে, তা কাজের কথা। ইশারাতে সেখানে শত ভাবের প্রকাশ। গ্লোবস পরিহিত শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। তরুণ নারী শ্রমিকরা যেন আধুনিক মেশিনগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন অহর্নিশ।
Advertisement
কাজে অযত্ন নেই, নেই কোনো অবহেলা। কারখানার শ্রমিকবান্ধব পরিবেশই তাদের আপন করে তুলেছে। পরিশ্রম আর নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরাও যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন সেখানে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ভিশন ফ্যান তৈরির কারখানা; যেন অন্য এক জগত। যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের কী মিতালি, তার-ই প্রমাণ মিলল দেশের অন্যতম বৃহৎ এ ফ্যান নির্মাণ কারখানায়।
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কারখানার যাত্রা শুরু ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে প্রথমে সীমিত পরিসরে ভিশন ফ্যান তৈরি শুরু হয়। শুরুর দিকে দৈনিক মাত্র একশ-দেড়শ ফ্যান তৈরি করা হতো। দুই বছরেই আমূল পরিবর্তন আসে উৎপাদনে। এখন প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ফ্যান তৈরি হচ্ছে এ ফ্যাক্টরিতে। প্রতি মাসে গড়ে ৬০ হাজার ফ্যান তৈরি হচ্ছে এখানে। দুই শিফটে প্রতিদিন মোট ৬০০ শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের ৬০ শতাংশই নারী। আগামীতে প্রতিষ্ঠানটিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
Advertisement
পরিকল্পনা রয়েছে উৎপাদন বাড়ানোরও। এ বছর দুই লাখ ৪০ হাজার ফ্যান বাজারজাত করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে, যা গতবারের (২০১৬) চেয়ে এক লাখ ১০ হাজার বেশি। ২০২০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে বলে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
আরএফএল ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড-এর নির্বাহী পরিচালক মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে আরএফএল গ্রুপের ভিশন ফ্যান। ভিশনের একটি স্বাভাবিক মানের সিলিং ফ্যান ৬১ ওয়াট থেকে ৬৫ ওয়াট বিদ্যুৎ ধারণ করে থাকে, যা ওই মানের অন্য ব্র্যান্ড বা কোম্পানির একটি ফ্যান ৮০ থেকে ৮৫ ওয়াট বিদ্যুৎ গ্রহণ করে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিলিং ফ্যানের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। এছাড়া নন-ব্র্যান্ড সিলিং ফ্যান ও অন্যান্য ফ্যানের চাহিদা রয়েছে আনুমানিক এক কোটি।
বাংলাদেশে ফ্যানের বাজার একসময় ছিল আমদানি নির্ভর। আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো আরএফএল গ্রুপও ফ্যান উৎপাদন শুরু করে। আধুনিক ডিজাইন ও মানসম্মত হওয়ায় ভিশন ফ্যান অল্প সময়ের মধ্যে ক্রেতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে।
Advertisement
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ভিশন সিলিং ফ্যান তিনটি মডেলে তৈরি হচ্ছে। এলিগ্যান্ট, সুপার ও রয়েল। আরও পাঁচটি ডিজাইন রয়েছে। সিলিং ফ্যানের দাম দুই হাজার ৫৫০ থেকে তিন হাজার ২৫০ টাকা। ভিশন ফ্যানের ডিলার ও আরএফএল-এর বিভিন্ন আউটলেট- বেস্টবাই, ভিশন ইম্পোরিয়াম ও ইজি বিল্ড-এর মাধ্যমে দেশের সর্বত্র এ পণ্য বাজারজাত করা হয়।
সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয় ভিশন ফ্যানের প্রতিটি পার্টস, বিশুদ্ধ কাঁচামাল দিয়ে তৈরির ফলে এর প্রতিটি অংশ অত্যন্ত মজবুত। বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম ইনগট নিশ্চিত করে দীর্ঘ স্থায়িত্বও নিশ্চিত করা হয়। আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় ডাই কাস্টিং মেশিনে তৈরি হচ্ছে ফ্যানের টপ কাভার, বটম কাভার ও রোটর। রোটর তৈরিতে ব্যবহৃত উন্নতমানের সিলিকন সিটের ফলে দীর্ঘ সময় চললেও ফ্যান গরম হয় না এবং নিশ্চিত করে ঠাণ্ডা বাতাস। আইপিএসের জন্যও এটি বিশেষ কার্যকর। অ্যারো ডাইনামিক পদ্ধতিতে পাখা তৈরি করা হয় বলে ফ্যানের বাতাসে বিশেষ ভারসাম্য বজায় থাকে।
কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আধুনিক কিউসি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া প্রতিটি ফ্যান তৈরির পর ভারসাম্য ও আরপিএম পরীক্ষার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
কারিগরি বিষয়ে ফ্যাক্টরির টেকনেশিয়ানরা জানান, ভিশন ফ্যানে রোবোটিক পদ্ধতিতে ডাই কাস্টিং করা হয়। এর ফলে ফ্যানের সঠিক পুরুত্ব থাকে ও কর্মীদের পরিশ্রমও কমে এসেছে। ডাই কাস্টিং থেকে সিএনসি লেদ মেশিনে আনা হয় ফ্যানের ফিনিশিংয়ের জন্য। কোনোরকম হাতের ছোঁয়া ছাড়া রোবটের সাহায্যে স্প্রের মাধ্যমে ফ্যানের রঙ করা হয়।
কথা হয়, আরএফএল ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রাহকের আস্থা ও চাহিদা পূরণে আমরা সক্ষম হয়েছি বলেই মাত্র দুই বছরে আমাদের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়াতে হয়। সামনের বছরের মধ্যেই আমরা উৎপাদন দ্বিগুণ করতে পারব বলে আশা করছি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জানান, টেকসই ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হওয়ায় ভিশন ফ্যান গ্রাহকের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যে কারণে আমাদের উৎপাদনের পরিধিও বাড়াতে হয়েছে কয়েকগুণ। আমরা দেশের বাইরেও ফ্যান রফতানি করার পরিকল্পনা নিয়েছি। ইতোমধ্যেই ভারত, চীন ও নেপালের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করেই ফ্যানের প্রতিটি অংশ তৈরি করছি।
এএসএস/জেডএ/এমএআর/এআরএস/পিআর