তবে কী এই-ই সত্য, নারীর না মরে মুক্তি নেই- অনেককাল আগে পড়া এই লাইনটি আজ আবার মনে পড়ছে। মনে পড়ছে নারী পুলিশ কনস্টেবল হালিমা বেগমের আত্মহত্যায়। হালিমা ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানায় চাকরি করতো। থাকতো ব্যারাকে। একরাতে সাব ইন্সপেক্টর মিজানুল তাকে ক্ষতি করবার ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, জোর করে ধর্ষণ করে ব্যারাকেই।
Advertisement
হালিমা ওসির কাছে বিচার চায়, লিখিত অভিযোগ করে। ওসি তা আমলে নেন না, গ্রহণ করেন না। অভিযোগ পড়ে থাকে অভিযোগের মতো। অসহায় হালিমা নিজের শরীরে আগুন দেয়- লজ্জায়, ঘৃণায়, ক্ষোভে, ক্রোধে। হালিমা মারা যায়। ঘটনাটি ২ এপ্রিলের। তবে ধর্ষণের অসভ্যতাটি আরো আগের, ১৭ মার্চে ঘটে। হালিমা তার এই ঘটনার সবই লিখে গেছেন তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে। লিখেছেন ‘আমার মরে যাওয়ার একমাত্র কারণ এসআই মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম আমাকে ধর্ষণ করেন। ১৭/৩/১৭ ইং রাত ২.০০ ঘটিকায়। আমার অভিযোগ অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গ্রহণ করে না।’
ব্যারাকের নারী পুলিশ কনস্টেবল হালিমার ধর্ষণ হবার এই ঘটনা জানতো অনেকেই। হাসাহাসি, তামাশা করতো। একদিকে জোরপূবর্ক ধর্ষিত হওয়া, অন্যদিকে বিচার তো দূরের কথা, অভিযোগের সুযোগই না হওয়া হালিমাকে বিপর্যস্থ করে তোলে। এ কোন অন্যায়, অবিচার, অসভ্যতা, নিপীড়ন, পাশবিকতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন হালিমা! হালিমা চিৎকার করে সত্যটি বলতে চায় কিন্তু পারে না, দেয় না তাকে সত্যটি প্রকাশ করতে। গলা চেপে ধরে- তথাকথিত প্রশাসন, বড় স্যার, ওসি। হালিমা নিজের জীবন দিয়ে সত্যটি প্রকাশ করে।
আর সবার মতো নারী পুলিশ সদস্য হালিমাও বাঁচতে চেয়েছিল। স্বপ্ন ছিল, জীবনের স্বপ্ন। হয়তো কনস্টেবল থেকে এএসআই হবে। জীবন উন্নত হবে। আর্থিক সাচ্ছন্দ্য আসবে। বাবাকে, ছোট ভাইকে টাকা পাঠাবে। কিন্তু নিজের পুলিশ বিভাগের, অন্য আরেক পুলিশে ধর্ষিত হবে, হয়তো দুঃস্বপ্ন ছিল। অভিযোগই যেখানে নেয়া হয়নি, বিচার তো অসম্ভব। হালিমা চাইলেও এই পুলিশতন্ত্র, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না জানে। বরং মেয়েটা নষ্ট, বাজে মেয়ে, চরিত্রহীন মেয়ে- এসব তাকে হামেশাই শুনতে হতো। হালিমাতো এই সমাজেরই, তারতো চারপাশটা ভালো করে দেখা, জানা। তাই সে নিজের মৃত্যুকেই ‘প্রমাণ’ হিসেবে রেখে গেল।
Advertisement
যে সাব ইন্সপেক্টর মিজানুল ইসলাম ধর্ষণ করেছে হালিমাকে, সে যেমন অপরাধী, তেমনি ওসি দেলোয়ার আহম্মেদ যিনি অভিযোগ নেননি, কম নয় তার অপরাধও। ধর্ষণ করা যেমন অপরাধ, তেমননি ধর্ষণের বিচার হতে না দেয়া তো ধর্ষণকে পৃষ্টপোষকতাই।ওসি দেলোয়ার, নারী কনস্টেবল হালিমার অভিযোগটি কেন নেননি? উনি কী তবে ধর্ষণ সমর্থন করেন? নাকি ধর্ষণকে পুরুষের এক ধরনের ‘যোগ্যতা’ ভাবেন? নাকি ভাবেন, ধর্ষণ এ আর এমন কী? একটা মেয়েই তো ধর্ষিত হয়েছে, ধর্ষণতো মেয়েরাই হবে- স্বাভাবিক। তা না হলে কেন, কি কারণে হালিমার অভিযোগটি নেনটি।
একটা বিষয় বেশ প্রচলিত, পুলিশ বিভাগে কেউ অন্যায়, অপরাধ করলে অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশের বড় কর্মকর্তারা প্রথমে বিষয়টিকে বেমালুম অস্বীকার করেন, পরে স্বীকার করে চেষ্টা করেন ধামাচাপা দেয়ার। বরং অপরাধীর অপরাধ শনাক্ত করে, শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, কিভাবে তাকে‘সুস্থ’ করা যায় সেই চেষ্টাটি করা উচিত। তা না করে তার অপরাধ আড়াল করলে সে তো ‘অসুস্থ’ই থেকে যাবে। পুলিশের অনেক অপরাধের ঘটনায়ই দেখা যায়, বদলি বা সাময়িক বরখাস্তকে ‘সল্যুশন’ মনে করা হয়। কিন্তু এই ‘সফট প্যারাসিটামলে’ কী আর রোগ সারে!
সে অন্যায় করে তার পরিচয় সে অপরাধী। সে আর তখন পুলিশ নয়। পুলিশ তো পজিটিভ চরিত্র। যে সত্য, যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করে, অপরাধকে দমন করে যে, সে পুলিশ। অপরাধী কখনো পুলিশ নয়। ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান কেন নিবে? ব্যক্তির অন্যায়, অপরাধ, দুঃশ্চরিত্রতা, দুর্বৃত্ততা- একান্ত ব্যক্তিরই। কেন অন্যায়কারীকে, অপরাধীকে বাঁচাতে হবে?
যে সাব ইন্সপেক্টর মিজানুল, নারী পুলিশ কনস্টেবল হালিমাকে ধর্ষণ করেছে, সে আসলে বিকৃতকাম, বিকারগ্রস্থ। ধর্ষণ কোন স্বাভাবিক যৌন আচরণ নয়। ধর্ষণে ব্যক্তি যে খুব যৌনসুখ বোধ করে তা নয়। ধর্ষণ ধস্তাধস্তি, জোরাজুড়ি, অন্যের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও জোরপূর্বক রতিক্রিয়া। মিজানুলের আনন্দ যৌনতায় নয়, জবরদস্তিতে। সে চুমু উপভোগ করে না, করে কামড়। শৃঙ্গারের চেয়ে তার কাছে ভাল লাগে আর্তনাদ, চিৎকার। সেক্সুয়াল পারভার্ট সে।
Advertisement
যারা মিজানুলকে কোন না কোনভাবে সমর্থন করতে চাইছেন, দোষ-অন্যায়-অপরাধ- আড়াল করতে চাইছেন, ভুল করছেন তারা। কেননা, ধর্ষক মিজানুল পুলিশ নয়, ‘বিকারগ্রস্ত’ পুরুষ।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্ট্রার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর